প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প কি ৪০০ মিলিয়ন ডলারের বিলাসবহুল বিমান উপহার নিতে পারেন?

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, কাতারের উপহার হিসেবে প্রস্তাবিত একটি বিমান গ্রহণ করতে চায় তার প্রশাসন। প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের এই বিমানকে তিনি বলেছেন 'চমৎকার সৌজন্য'। বিমানটি ফিরিয়ে দিলে সেটি 'বোকামি' হবে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। খবর বিবিসি'র।
তবে বিরোধী ডেমোক্রেটিক পার্টির কিছু সদস্য এই সম্ভাব্য সিদ্ধান্তকে আখ্যা দিয়েছেন 'চরমভাবে অবৈধ' হিসেবে। হোয়াইট হাউজ অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এমনকি ট্রাম্পের নিজ দলের কিছু সমর্থকরাও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অন্যদিকে, কাতার সরকার বলেছে—বিমান সংক্রান্ত যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো 'সঠিক নয়'। তাদের দাবি, এখনো আলোচনা চলছে।
এই খবরে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর। সফরের অংশ হিসেবে তিনি কাতারসহ কয়েকটি দেশ পরিদর্শন করছেন।
আরও পড়ুন: উপহার হিসেবে কাতারের বিমান না নেওয়াটা 'বোকামি' হবে: ট্রাম্প
কী জানা গেছে সেই বিমান সম্পর্কে?
রোববার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন কাতারের রাজপরিবারের কাছ থেকে একটি বোয়িং জাম্বো জেট উপহার হিসেবে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিমানটি পুনর্গঠন করে সাময়িকভাবে 'এয়ার ফোর্স ওয়ান' হিসেবে ব্যবহার করা হবে—যেটি মার্কিন প্রেসিডেন্টদের বহনের জন্য নির্ধারিত বিমানের নাম।
পরে ট্রাম্প 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ একটি বার্তা দিয়ে লেখেন, 'প্রতিরক্ষা বিভাগ একটি ৭৪৭ বিমান পাচ্ছে উপহার হিসেবে—বিনামূল্যে। এটি ৪০ বছর পুরোনো এয়ার ফোর্স ওয়ানের পরিবর্তে সাময়িকভাবে ব্যবহৃত হবে। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঘটছে।'
পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, 'কাতারের পক্ষ থেকে এটি একটি চমৎকার অঙ্গীকার। আমি এর জন্য কৃতজ্ঞ। এ ধরনের প্রস্তাব আমি কখনো ফিরিয়ে দিই না।'
এর আগে ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প জানিয়েছিলেন, বোয়িং কোম্পানির প্রতি নতুন দুটি এয়ার ফোর্স ওয়ান বিমানের সরবরাহে বিলম্ব নিয়ে তিনি 'খুশি নন'। সে সময় তিনি বলেছিলেন, হোয়াইট হাউজ চাইলে 'একটি বিমান কিনতে বা জোগাড় করতে পারে, বা অন্য কিছু করতে পারে।'
ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডার পাম বিচে একটি কাতারি বিমানকে দেখা যায় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটি পরিদর্শন করেন। ২০১৫ সালের স্পেসিফিকেশন সারাংশ অনুযায়ী, বিমানটিতে বর্তমানে তিনটি বেডরুম, একটি ব্যক্তিগত লাউঞ্জ ও একটি অফিস রয়েছে।

সিএনএন-কে এক কাতারি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই বিমানটি কাতারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পেন্টাগনের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে এবং এটি 'এয়ার ফোর্স ওয়ান'-এর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা মান পূরণের জন্য পুনঃনির্মাণ করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পরিবর্তন সম্পন্ন করতে কয়েক বছর সময় লাগবে। ফলে ট্রাম্পের বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত বিমানটি সম্ভবত ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হবে না।
ট্রাম্প নিজেই জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তিনি এই বিমানটি সরাসরি নিজের প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দেবেন এবং সেটি আর ব্যবহার করবেন না। তার ভাষায়, 'আমি এটি প্রেসিডেন্সি শেষ হওয়ার পর আর ব্যবহার করব না।'
তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে, শুধু ডেমোক্র্যাটদের পক্ষ থেকেই নয়, বরং ট্রাম্পপন্থী বহু পুরোনো সমর্থকদের মধ্য থেকেও। এর মধ্যে অন্যতম কট্টরপন্থী ট্রাম্প সমর্থক লরা লুমার বলেছেন, 'যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে এটি প্রশাসনের জন্য এক বড় কলঙ্ক হয়ে থাকবে।'
এই উপহার কী বৈধ?
একাধিক জ্যেষ্ঠ ডেমোক্র্যাট নেতা দাবি করেছেন, উপহার গ্রহণ করাটা অবৈধ হতে পারে।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর অ্যাডাম শিফ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের একটি ধারা উদ্ধৃত করে বলেন, কোনও নির্বাচিত কর্মকর্তা কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়া কোনো বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে 'যে কোনও ধরনের উপহার' গ্রহণ করতে পারেন না।
ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার আমেরিকান ইতিহাসের অধ্যাপক ফ্র্যাংক কগলিয়ানো বলেন, এই ধারাটি মূলত সরকারকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ঘুষ দেওয়ার প্রবণতা ঠেকাতে সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছিল।
লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যান্ড্রু মোরান বলেন, 'এটা অবশ্যই সংবিধানের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং এর আগে এ ধরনের বা এত বড় আকারের উপহার আমরা দেখিনি।'
আরো পড়ুন: কাতার থেকে বোয়িংয়ের বিলাসবহুল বিমান উপহার নিতে চান ট্রাম্প
মার্কিন কংগ্রেস এখন পর্যন্ত বিদেশি উপহার গ্রহণসংক্রান্ত একাধিক আইন পাস করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে ১৯৬৬ সালের 'ফরেন গিফটস অ্যান্ড ডেকোরেশনস অ্যাক্ট'। এই আইনের ফলে নির্দিষ্ট মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যের কোনো বিদেশি উপহার গ্রহণ করতে হলে কংগ্রেসের সম্মতি প্রয়োজন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ৪৮০ ডলার মূল্যের কম উপহার গ্রহণ করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিমানটি একসময় তার 'লাইব্রেরিতে' যাবে বলে মন্তব্য করেছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা, তিনি প্রকৃতপক্ষে তার জাদুঘর ফাউন্ডেশনকে বোঝাতে চেয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের সাধারণত দুটি প্রতিষ্ঠান থাকে—একটি লাইব্রেরি, যেখানে তাদের দলিল-আর্কাইভ রাখা হয়; আরেকটি হচ্ছে জাদুঘর, যেখানে তাদের নানা স্মারক প্রদর্শন করা হয় এবং যা সাধারণত ব্যক্তিগত অনুদানে পরিচালিত হয়ে থাকে ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
বিবিসি–কে দেওয়া বক্তব্যে বিশেষজ্ঞরা জানান, বিমানটি প্রেসিডেন্টকে সরাসরি না দিয়ে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তরের পর সেটি জাদুঘরে দেওয়া হলেও তা সম্ভবত সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে রেহাই পাবে না।
সিটিজেন্স ফর রেসপনসিবিলিটি অ্যান্ড এথিকস ইন ওয়াশিংটন (ক্রু) নামের একটি সংস্থার জর্ডান লিবোভিটজ মন্তব্য করেছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যদি পদত্যাগের পর সেই বিশেষ বিমান ব্যবহার করেন, তাহলে তা 'সীমা অতিক্রম' হবে। তিনি বলেন, 'রোনাল্ড রিগানের এয়ার ফোর্স ওয়ান পরে তার প্রেসিডেনশিয়াল লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছিল। তবে সেক্ষেত্রে বিষয়টি ছিল ভিন্ন। বিমানটি অবসরে পাঠানো হয়েছিল, রিগান কখনো তা আবার ব্যবহার করেননি, বরং সেটি এখন একটি জাদুঘরের অংশ।'

যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ একটি স্মারক খসড়া প্রস্তুত করেছে বলে জানা গেছে, যেখানে ট্রাম্পের বিমান গ্রহণের বিষয়টি আইনগতভাবে বৈধ বলে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। তবে এই স্মারকটি এখনো প্রকাশ করা হয়নি।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিটকে যখন চুক্তির আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, 'এই বিষয়টির আইনি দিক নির্ধারণের প্রক্রিয়া এখনো চলমান। তবে স্বাভাবিকভাবেই এই সরকার যে কোনো অনুদান সবসময় আইন মেনেই গ্রহণ করে।'
ট্রাম্পের পরিবার মধ্যপ্রাচ্যে কী করছে?
ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানে চার দিনের সফরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে রয়েছেন। এই সফরের মূল লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা।
এই সফরের আগে ট্রাম্প অর্গানাইজেশন একাধিক ব্যবসায়িক চুক্তির ঘোষণা দিয়েছে। ট্রাম্পের দুই ছেলে এরিক ট্রাম্প ও ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়রের পরিচালনায় প্রতিষ্ঠানটি কাতার ও আমিরাতে গলফ কোর্স ও বিলাসবহুল ভিলা নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট 'ট্রাম্প অর্গানাইজেশন'-এর ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব সন্তানদের হাতে তুলে দেন। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত নন।
মে মাসের শুরুতেই ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়, কাতারের রাজধানী দোহার উত্তরে একটি বিলাসবহুল ১৮-হোলের গলফ কোর্স এবং একঝাঁক অভিজাত ভিলার নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রকল্পে ট্রাম্প ব্র্যান্ডের নাম ব্যবহার করা হবে।
ঘোষণার সময় প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট এরিক ট্রাম্প বলেন, 'কাতারি দিয়ার এবং দার গ্লোবালের সঙ্গে কাতারে এই অসাধারণ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে ট্রাম্প ব্র্যান্ডকে বিস্তৃত করতে পেরে আমরা অত্যন্ত গর্বিত।'
উল্লেখ্য, দার গ্লোবাল একটি সৌদি আরবভিত্তিক পাবলিক মালিকানাধীন নির্মাণ সংস্থা; আর কাতারি দিয়ার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত কাতারি প্রতিষ্ঠান।
এর আগে, ৩০ এপ্রিল ট্রাম্প অর্গানাইজেশন ঘোষণা দেয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের 'কেন্দ্রস্থলে' তারা নির্মাণ করতে যাচ্ছে 'এই অঞ্চলের প্রথম ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড টাওয়ার'। ৮০ তলা বিশিষ্ট এই ভবনে থাকবে 'বিলাসবহুল আবাসন ও বিশ্বমানের আতিথেয়তা'।
সম্প্রতি এরিক ট্রাম্প সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন এবং ১ মে দুবাইয়ে আয়োজিত 'টোকেন ২০৪৯' নামের একটি ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন।
এই সফরের সময় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পারিবারিক ব্যবসায় জড়িত কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, 'রাষ্ট্রপতি নিজের স্বার্থে কিছু করছেন—এমন ধারণা একেবারেই হাস্যকর।'