চড়চড় করে বাড়ছে সোনার দাম: গয়না বেচে দিতে, গলিয়ে ফেলতে হুড়মুড়িয়ে দোকানে ছুটছে মার্কিনীরা

যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় গয়নার বাজার। কয়েকদিন আগের কথা। আলবার্তো হার্নান্দেজ মেশিনটা চালু করে অপেক্ষা করতে থাকলেন। ভেতরটা আগুনের মতো লালচে কমলা হয়ে উঠতেই সাবানের টুকরোর ওজনের সমান, প্রায় ১০০ গ্রাম বা ৩.২ ট্রয় আউন্স ওজনের আংটি, কানের দুল আর হার ঢেলে দিলেন মেশিনে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গলে ফুটতে থাকা ধাতু ঠান্ডা হয়ে মেয়েদের জুতোর মাপের আকারে তৈরি ছাঁচে চতুর্ভুজের মতো রূপ পেল। এক্স-রে মেশিনে দেখা গেল, এতে সোনা রয়েছে ৫৬.৫ শতাংশ। ওই দিনের সোনার দামে এর মূল্য দাঁড়ায় ১ লাখ ৭৭ হাজার ডলার।
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মাঝে যখন সোনার দাম রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন লস অ্যাঞ্জেলসের ডাউনটাউনের সেন্ট ভিনসেন্ট জুয়েলারি সেন্টারে প্রতিদিনই লাখ লাখ ডলারের সোনা বেচাকেনা হচ্ছে।
এ সেন্টারের প্রায় ৫০০ স্বাধীন ব্যবসায়ীর মধ্যে যারা গয়না ব্যবসায়ী, সোনা পরিশোধনকারী বা সোনার বিশুদ্ধতা পরীক্ষাকারী, তারা বলছেন: গ্রাহকের এমন ভিড় তারা আগে কখনও দেখেননি।
আলবার্তোর ভাগ্নে সাবাশডেন হার্নান্দেজ কাজ করেন এঅ্যান্ডএম প্রেশাস মেটালস-এ। তিনি বললেন, 'এই মুহূর্তে অনেক র্যাপার আর অন্যরাও তাদের বড় গয়নাগুলো গলিয়ে ফেলছেন। অনেক নতুন গ্রাহক আসছেন, তাদের দাদা-নানার পুরনো সব অলঙ্কার নিয়ে এসে সোজা গলিয়ে ফেলছেন।'
সোনার এই উত্থান এমন এক সময়ে ঘটেছে, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বারবার শুল্ক নিয়ে নানা ঘোষণা দিয়ে আর্থিক বাজার অস্থিরতা করে তুলছেন এবং মূল্যস্ফীতি ফের উসকে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছেন।
এই অনিশ্চয়তা থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রান্তের মানুষ তাৎক্ষণিক অর্থপ্রাপ্তির জন্য ছুটছে পুরনো গয়না বেচে দিতে বা গলিয়ে ফেলতে। এই দলে আছে বন্ধকি দোকানের মালিকেরাও। অন্যদিকে অনেকে মনে করছেন, অস্থিতিশীল শেয়ারবাজারের তুলনায় সোনায় বিনিয়োগ বেশি নিরাপদ হবে। তাই তারাও যতটা সম্ভব, সোনা কিনে নিচ্ছেন।
লস অ্যাঞ্জেলসের গয়না ব্যবসায়ী অলিভিয়া কাজানজিয়ান বলেন, লোকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া প্রাচীন পারিবারিক গয়নাও নিয়ে আসছে।
'বিয়ের তারিখ খোদাই করা, এমনকি ১৮০০-এর দশকের জিনিসও গলিয়ে ফেলছেন তারা,' বলেন তিনি।
কাজানজিয়ান সম্প্রতি একজনের কাছ থেকে ৩ হাজার ২০০ ডলার দিয়ে ১৪ ক্যারেট সোনার কাজ করা একটি নীল এনামেলের ব্রেসলেট কিনেছেন।
তবে কাজানজিয়ানের ওই গয়না গলিয়ে ফেলার ইচ্ছে নেই। তিনি বলেন, শিল্পমূল্য আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় জিনিসটির প্রকৃত দাম অনেক বেশি হবে।
কাজানজিয়ান বলেন, কয়েকজন গ্রাহককে তিনি বুঝিয়ে সিদ্ধান্ত বদল করিয়েছেন। 'বলেছি এটা ইতিহাসের টুকরো। উত্তরাধিকারসূত্রে এমন জিনিস পেলে আপনি ভাগ্যবান, আপনার পরিবারের টুকরো পেয়েছেন।'
যারা সোনার বার বা অন্যান্য মূল্যবান ধাতু বিক্রি করছেন, তারাও চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
পেনসিলভানিয়ার স্টেফকো ক্যাশ ফর গোল্ড সারা আমেরিকার গ্রাহকদের কাছ থেকে সোনা কেনে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক এডউইন ফেইহো বলেন, 'মাল আসার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। সবাই এখন দৌড়ের ওপর আছে।'
তবে স্বর্ণজ্বর থেকে সবাই যে মুনাফা করতে পারছেন, তা নয়।
যেসব গয়না ব্যবসায়ী ইতালি, তুরস্ক কিংবা চীন থেকে পণ্য আনেন, তাদেরকে সোনা কিনতে বেশি দামে—তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে বাড়তি শুল্ক। ফলে তাদের মুনাফার মার্জিন কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে চাহিদাও।
পুজান্ট বারবেরিয়ানের পরিবার ১৯৮৩ সালে সেন্ট ভিনসেন্টে ভিঅ্যান্ডপি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠা করে। তিনি বলেন, 'আমাদের লাভের মার্জিন খুবই কম।' সম্প্রতি বিদেশ থেকে আসা একটি প্যাকেজে তার বাড়তি ১৬ হাজার ডলার খরচ হয়েছে বলে জানান তিনি।
ক্রেতারাও ধাক্কা খাচ্ছেন, যখন দেখছেন এক বছর আগের দামে এখন কিছুই কেনা যাচ্ছে না।
বারবেরিয়ান বলেন, গত বছরও যেখানে ১০ গ্রাম (০.৩২ ট্রয় আউন্স) ওজনের মোটা ১৪ ক্যারেটের সোনার ব্রেসলেট বিক্রি হতো ৬০০ ডলারে, এখন তার দাম পড়ছে ৯০০ ডলারের কাছাকাছি।
অনেকেই মনে করছেন, ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষের জন্যই এই প্রবণতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
নিউপোর্ট গোল্ড পোস্ট ইনক. নাম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী স্যাম নিউয়েন বলেন, যারা সোনার বার কিনতে চাইছেন, তারা ভাবছেন 'সোনার দাম আরও বাড়বে'।
নিউয়েন গত পাঁচ বছর ধরে সেন্ট ভিনসেন্টে সোনা ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু কেনাবেচা করছেন। প্রতি ট্রয় আউন্স সোনার দাম রেকর্ড ৩ হাজার ৫০০ ডলার থেকে কিছুটা কমলেও তার ধারণ, বছরের শেষে তা ৪ হাজার বা ৫ হাজার ডলারেও উঠে যেতে পারে।
এ ব্যাপারে বিনিয়োগ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্য গোল্ড অ্যাডভাইজর-এর প্রতিষ্ঠাতা জেফ ক্লার্কও একমত। তিনি বলেন, মানুষ যদি মন্দার ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে, তাহলে সোনার দাম আরও বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ক্লার্ক আরও বলেন, 'ইতিহাস বলে, অতীতে সোনার দাম এরচেয়েও অনেক বেড়েছে। এই ভয় আর অনিশ্চয়তা যদি সাধারণ মানুষের মধ্যে চলতেই থাকে, তাহলে দামও বাড়তেই থাকবে।'
উল্লেখ্য, ১৯৭০-এর দশকে দুই অঙ্কের মূল্যস্ফীতির সময় সোনার দাম ১৭ গুণ বেড়ে গিয়েছিল।