পরস্পরের সাড়া পেলে উত্তেজনা কমাতে প্রস্তুত ভারত ও পাকিস্তান

পারস্পরিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর উত্তেজনা প্রশমনের ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে চলমান সংঘাত নতুন করে বিস্ফোরণ ঘটালেও শনিবার (১০ মে) উভয় পক্ষই সহিংসতা থেকে সরে আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে।
গত মাসে ভারতের একটি এলাকায় বন্দুকধারীদের হামলায় বহু প্রাণহানি ঘটে, যার জন্য নয়াদিল্লি ইসলামাবাদকে দায়ী করে আসছে। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে থাকে।
শনিবার ভোরে পাকিস্তান ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলোর দিকে একাধিক উচ্চগতির ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। ভারতের দাবি, জবাবে তারা পাকিস্তানের কয়েকটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায়।
পাকিস্তান জানায়, তারা বেশিরভাগ ক্ষেপণাস্ত্র মাঝপথেই ভূপাতিত করেছে এবং পালটা হামলাও শুরু হয়েছে।
এর মধ্যেই পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, ভারত যদি আর কোনো হামলা না চালায়, তাহলে তার দেশও উত্তেজনা কমানোর চিন্তা করবে। তবে তিনি সতর্ক করে দেন, 'ভারত যদি আবার হামলা চালায়, আমাদের জবাবও প্রস্তুত থাকবে।'
জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দার বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গেও তিনি এই বার্তা ভাগাভাগি করেছেন। রুবিও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের সঙ্গে কথা বলার পর দারকে ফোন করেন।
'আমাদের ধৈর্যের সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই আমরা জবাব দিয়েছি। যদি এখানেই সব থেমে যায়, তাহলে আমরা পরিস্থিতি বিবেচনায় নেব,' বলেন ইসহাক দার।
এদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ট্যামি ব্রুস জানান, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের ওপর জোর দিয়েছেন রুবিও। তিনি বলেছেন, ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে উভয় পক্ষের উচিত শান্তিপূর্ণ পথ খোঁজা। যুক্তরাষ্ট্র এ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার জন্য সহায়তা দিতে প্রস্তুত বলেও জানান তিনি।
'উত্তেজনা না বাড়ানোর' পক্ষে ভারত
ভারতের সেনা কর্মকর্তা কর্নেল সোফিয়া কুরেশি শনিবার নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, পাকিস্তান কাশ্মীরের ভারত নিয়ন্ত্রিত অংশে তিনটি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলার পাশাপাশি, সেখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা চালিয়েছে। তার ভাষ্যে, 'পাকিস্তানের কর্মকাণ্ডের যথোপযুক্ত জবাব দেয়া হয়েছে।'
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর উইং কমান্ডার ব্যোমিকা সিং। তিনি জানান, ভারত উত্তেজনা না বাড়ানোর পক্ষে অটল—যদি পাকিস্তানও সেই পথে চলে। তবে পাকিস্তানি স্থলবাহিনীকে সীমান্তের সামনে এগিয়ে যেতে দেখা গেছে, যা তাদের 'আক্রমণাত্মক মনোভাব ও উত্তেজনা বাড়ানোর ইঙ্গিত' বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'ভারতের সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।'
ব্যোমিকা সিং জানান, পাকিস্তানের হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় বাহিনী শুধু নির্ধারিত সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সুনির্দিষ্ট হামলা চালিয়েছে। এসব লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে ছিল কারিগরি অবকাঠামো, কমান্ড ও কন্ট্রোল সেন্টার, রাডার সাইট এবং অস্ত্র মজুতকেন্দ্র—যাতে বেসামরিক ক্ষতি যথাসম্ভব কম হয়।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান শুক্রবার রাতে একাধিক উচ্চগতির ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল, যেগুলোর লক্ষ্য ছিল ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের বিভিন্ন বিমানঘাঁটি এবং বেসামরিক স্থাপনা।
উইং কমান্ডার বলেন, 'সব ধরনের শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড কার্যকরভাবে প্রতিহত করা ও যথাযথভাবে জবাব দেওয়া হয়েছে।'
পাকিস্তান দাবি করেছিল, তারা ভারতের একাধিক বিমানঘাঁটি ধ্বংস করেছে এবং ভারী অস্ত্র গুদাম, সামরিক স্থাপনা ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো—যেমন বিদ্যুৎকেন্দ্রেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়েছে। তবে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা মাঝারি পাল্লার 'ফাতেহ' ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে ভারতের মিসাইল সংরক্ষণাগার এবং পাঠানকোট ও উধমপুর শহরের বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে।
তবে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানায়, পাকিস্তান বা ভারতের পক্ষ থেকে যেসব হামলার দাবি করা হয়েছে, তা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমাদ শরীফ বলেন, ভারতীয় হামলার পরও পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর সব সরঞ্জাম নিরাপদ রয়েছে। তিনি জানান, ভারতের ছোড়া কিছু মিসাইল ভারতেরই পূর্ব পাঞ্জাবে আঘাত হেনেছে।
রাওয়ালপিন্ডির বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় হামলা
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাকিস্তান টেলিভিশন (পিটিভি) জানিয়েছে, ভারতের হামলার পর প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ জাতীয় কমান্ড কর্তৃপক্ষের জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। এই কর্তৃপক্ষ দেশের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ও অন্যান্য কৌশলগত সম্পদের তত্ত্বাবধান করে।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে ২২ এপ্রিল। ওইদিন ভারতের নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রে হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই হিন্দু ভারতীয় পর্যটক। নয়াদিল্লি এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। তবে ইসলামাবাদ এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
পাকিস্তানের সামরিক মুখপাত্র জানান, শনিবার ভারত যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, তার লক্ষ্য ছিল রাওয়ালপিন্ডির নূর খান বিমানঘাঁটি—যেটি রাজধানী ইসলামাবাদের কাছেই অবস্থিত। এছাড়া চকওয়াল শহরের মুরিদ বিমানঘাঁটি এবং পাঞ্জাব প্রদেশের ঝাং জেলার রফিকি বিমানঘাঁটিতেও হামলা হয়েছে।
ঘনবসতিপূর্ণ শহর রাওয়ালপিন্ডিতে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার ছিল না। স্থানীয়দের মধ্যেও কেউ হামলার শব্দ বা এর পরিণতি নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু জানাননি
পাকিস্তানের পালটা হামলা
পাকিস্তানের প্রতিশোধমূলক হামলার ঘোষণার পর ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের বাসিন্দারা জানান, শ্রীনগর ও জম্মু শহরসহ একাধিক স্থানে তারা তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। এসব শব্দ শোনা গেছে সেনাঘাঁটি থাকা শহর উধমপুরেও।
'গত দুই রাতে ড্রোন হামলার সময় যেসব বিস্ফোরণ শুনেছিলাম, আজকেরটা সেগুলোর চেয়ে আলাদা,' বলেন জম্মুর বাসিন্দা ও অঞ্চলটির সাবেক পুলিশ প্রধান শেশ পাল বৈদ। 'এখানে এখন যেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।'
বৈদ আরও জানান, বিস্ফোরণের শব্দ এসেছে মূলত সামরিক ঘাঁটির কাছাকাছি এলাকা থেকে। তার মতে, এসব ঘাঁটিই হামলার লক্ষ্য।
শনিবার সকাল নাগাদ শ্রীনগরে তুলনামূলক শান্ত পরিস্থিতি দেখা গেলেও শহরের বিমানবন্দরসংলগ্ন বিমানঘাঁটির আশপাশের বাসিন্দারা জানান, বিস্ফোরণের শব্দ এবং যুদ্ধবিমানগুলোর গর্জনে তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
শ্রীনগরের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইয়াসিন বলেন, 'আমি তখন জেগেই ছিলাম, কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দে আমার বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে কান্না শুরু করে।' অন্তত দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি ।
আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষক সংস্থার (ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ) ভারতের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক প্রবীন দন্তির মতে, আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা না করলেও, ভারত ও পাকিস্তান এখন কার্যত এক যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেন, 'এটা এখন এক ধরনের নির্মম প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে—কে কার চেয়ে বেশি সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারে। অথচ দুপক্ষেরই কোনও স্পষ্ট কৌশলগত লক্ষ্য নেই।'
'বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, তাতে এখন এই সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে', যোগ করেন তিনি।