নয়াদিল্লিতে সৌদি ও ইরানি মন্ত্রী; পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পূর্বে যেসব তৃতীয় পক্ষ মধ্যস্থতা করেছে

কাশ্মীরের পেহেলগাম হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নতুন করে উত্তপ্ত হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপ তীব্রতর হচ্ছে। বুধবার (৭ মে) পাকিস্তানে ভারতীয় হামলার ঠিক পরেই, রাতেই নয়াদিল্লিতে পৌঁছান সৌদি আরবের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইর। একই সময়ে একদিনের সফরে ভারতে পা রাখেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইয়্যেদ আব্বাস আরাঘচি।
বৃহস্পতিবার (৮ মে) সকালে সৌদি মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ লিখেছেন, 'সৌদি আরবের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আদেল আল-জুবেইরের সঙ্গে গঠনমূলক বৈঠক হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারত কীভাবে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে, সে বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তাকে জানানো হয়েছে।'
সূত্র অনুযায়ী, আল-জুবেইরের সফর পূর্বঘোষিত ছিল না। মূলত ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটেই এই সফর আয়োজিত হয়।

এদিকে আজ দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে জয়শঙ্কর ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচির সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে সোমবার (৫ মে) আরাঘচি পাকিস্তান সফর করেন। তিনি ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'পেহেলগামে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর থেকে পরিস্থিতি যে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা প্রশমিত করতে আলোচনাই একমাত্র পথ।'
ইরানের সঙ্গে বৈঠকে ভারত জানিয়েছে, নতুন করে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে চায় না নয়াদিল্লি। কিন্তু পাকিস্তান যদি সামরিক আক্রমণ করে, তাহলে তার যোগ্য জবাব দেবে ভারত।
জয়শঙ্কর বলেন, 'এমন একটা সময়ে আপনারা [আরাঘচির নেতৃত্বে যৌথ কমিশন] ভারতে এসেছেন, যখন জম্মু-কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ এক হত্যাকাণ্ডের জবাব দিতে আমরা ব্যস্ত। জম্মু-কাশ্মীরের ওই হামলা আমাদের সীমান্তপারের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে বাধ্য করেছে। আমরা লক্ষ্যবস্তু বেছে বেছেই পালটা আঘাত করেছি।'
এ সময় জয়শঙ্কর বলেন, 'পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠুক, তা আমরা চাই না। তবে আমাদের ওপর আঘাত এলে নিঃসন্দেহে আমরা তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করব।'
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জয়শঙ্কর বলেন, 'আপনারা আমাদের প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠ সহযোগী। আপনাদের জন্য এই পরিস্থিতি বিশদভাবে জানা জরুরি।'
পেহেলগাম হামলায় ২৬ জন নিহত এবং বহু মানুষ আহত হন। এই হামলার তদন্তে ভারতের পক্ষ থেকে সৌদি আরবসহ একাধিক দেশের কূটনীতিকদের অবহিত করা হয়। ভারত পেহেলগামের ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানাবার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহানের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।
এর আগে যারা মধ্যস্থতা করেছিল
ভারত বরাবরই কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার বিরোধিতা করে এসেছে। তবে, অতীতে দেশ দুটি সামরিক সংঘাতে জড়ালে বাইরের হস্তক্ষেপ অনেক সময় শান্তির পথে যেতে সাহায্য করেছে।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শেষ হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যস্থতায় তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে। এতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যুদ্ধ-পূর্ব সীমান্তে ফিরে যাওয়াসহ কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মত হন।
এরপর, ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তান-সমর্থিত বিদ্রোহী ও সেনারা নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে ভারতের ভূখণ্ড দখল করেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের চাপেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য হন। প্রায় দশ সপ্তাহের এই সংঘাতে উভয় পক্ষের প্রায় এক হাজার সেনা নিহত হন।
আন্তর্জাতিক কৌশলবিদ আকতার বলেন, 'তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ঐতিহাসিকভাবে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই দুই দেশের মধ্যে সরাসরি উত্তেজনা নিরসনের কোনো প্রক্রিয়া না থাকায় তৃতীয় পক্ষকে তারা নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে এগুলো ব্যর্থ হলেও সম্মানরক্ষার সুযোগ দিয়ে সংঘাত থেকে পিছিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।'
আন্তর্জাতিক ক্রাইসিস গ্রুপের ডনথি বলেন, 'বর্তমানে উভয় দেশ অভ্যন্তরীণ চাপে ঝুঁকি নিতে আগ্রহী, তাই এ সময়ে মধ্যস্থতা কঠিন হবে। এই সংকট সামাল দিতে হলে বন্ধু রাষ্ট্র ও বড় শক্তিগুলোর সমন্বিত ও ধারাবাহিক চাপ প্রয়োজন।'
এখন পর্যন্ত যারা মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে
সম্প্রতি পেহেলগাম হামলার প্রেক্ষিতে ভারত পাকিস্তানে হামলা চালায়। তবে পাকিস্তানে ভারতের হামলার আগেই কয়েকটি দেশ সংকট প্রশমনে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়:
চীন: পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তদন্তে চীনের ভূমিকা জানতে চাওয়ার পর চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গুও জিয়াকুন বলেন, 'আমরা ন্যায়সঙ্গত ও নিরপেক্ষ তদন্ত চাই এবং আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সংলাপ ও পরামর্শ জরুরি।'
রাশিয়া: রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ৪ মে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দারের সঙ্গে ফোনে বলেন, 'ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি উভয়ের সদিচ্ছা থাকলে মস্কো রাজনৈতিক সমাধানে ভূমিকা নিতে প্রস্তুত।' এর আগে, ২ মে তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গেও কথা বলেন।
ইরান: পেহেলগাম হামলার চার দিন পর এক্সে দেওয়া এক বার্তায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাঘচি বলেন, 'এই কঠিন সময়ে ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লির মধ্যে বোঝাপড়ায় সাহায্য করতে তেহরান তার কূটনৈতিক প্রভাব কাজে লাগাতে প্রস্তুত।'
মালয়েশিয়া: মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম এক্সে এক বার্তায় পাকিস্তানের স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্ত চাওয়ার আহ্বানকে সমর্থন জানান।