বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের বিশ্বমঞ্চে চীনের পদক্ষেপ, আমেরিকা কি প্রস্তুত?

সাংহাই অটো শো ২০২৫' যেন বিশ্বকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়ে গেল: উদ্ভাবনের শীর্ষে এখন চীন, এবং এই নেতৃত্বের কথা গোটা পৃথিবীকে জানাতে চায় বেইজিং।
চীনের আর্থিক রাজধানীতে আয়োজিত এই বিশাল আয়োজনে ছিল ৬০টির বেশি ফুটবল মাঠ সমান এলাকা—যেখানে দেশি ও বিদেশি নির্মাতারা তাদের নতুন মডেল উন্মোচনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
জমজমাট সঙ্গীতের তালে তালে প্রযুক্তি সমৃদ্ধ গাড়ি, দ্রুত চার্জ নেওয়া ব্যাটারি, স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং সিস্টেম আর এমনকি উড়ন্ত যানবাহনও হাজির ছিল এই প্রদর্শনীতে। কিন্তু এবারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল চীনা ব্র্যান্ডগুলো, বিশেষ করে ইভি জায়ান্ট বিওয়াইডি।
বিওয়াইডির নতুন স্পোর্টস কার ডেনজা জেড- এর উন্মোচনের সময় প্রাক্তন অডি ও ল্যাম্বোরগিনি ডিজাইনার ভলফগ্যাং এগার বললেন, "এটি আবেগঘন ডিজাইন ও চূড়ান্ত পারফরম্যান্সের প্রতীক।" দর্শক সারি থেকে কেউ কেউ চিৎকার করে বললেন, "আমরা তোমাকে ভালোবাসি!"
অন্যদিকে, শাওমির বৈদ্যুতিক গাড়ি দেখার জন্য ভিড়ের সারি পৌঁছায় প্রদর্শনীর বাইরে পর্যন্ত। নিও'র বিলাসবহুল সেডান ইটি৯–কে দেখতে উৎসুক জনতা জমা হয়েছিল প্রযুক্তির এমন প্রদর্শনীতে যাতে অতীতে কেবল জার্মান, আমেরিকান বা জাপানি কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল।
বাণিজ্যযুদ্ধের ছায়া ও চীনের টেকসই অগ্রগতি
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্কনীতির কারণে, যদিও বৈশ্বিক অটোমোবাইল শিল্পে অনিশ্চয়তা তৈরি হলেও, চীনা ইভি কোম্পানিগুলো দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে।
২০২৩ সালে, বিওয়াইডি মার্কিন জায়ান্ট টেসলাকে ছাড়িয়ে বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ি বিক্রিতে শীর্ষে উঠে আসে। দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারও এখন চীনা গাড়ির দখল বেশি—বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো হার মানছে প্রতিনিয়ত।
এনার্জি বিশ্লেষণ প্রতিষ্ঠান রোহ মোশন জানায়, বৈশ্বিক ইভি বাজারের ৬০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করছে এখন চীন।

প্রযুক্তিতে নজরকাড়া অগ্রগতি
চীনে বর্তমানে গাড়ির মূল্য ও প্রযুক্তির একটি তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। মার্চ মাসে বিওয়াইডির এমন একটি ব্যাটারি উন্মোচন করে, যা মাত্র ৫ মিনিটের চার্জে ২৫০ মাইল চলতে পারে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই সিএটিএল দাবি করে, তার ব্যাটারি একই সময় ধরে চার্জ করার পর ৩২০ মাইল চলবে।
হুয়াওয়ে, মোমেন্টা-এর মতো কোম্পানিগুলো স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে। বিওয়াইডি তার "গডস আই" ড্রাইভার অ্যাসিস্টেন্স সিস্টেম প্রায় সব মডেলে বিনামূল্যে দেবে বলে ঘোষণা করেছে।
বৈশ্বিক বাজার দখলের লড়াই
চীনা কোম্পানিগুলো এখন ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, লাতিন আমেরিকা—সবখানেই বাজার খুঁজছে। প্রথম প্রান্তিকে তারা ৪.৪১ লাখ ইভি রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।
তবে স্থানীয় বাজারে অতিরিক্ত উৎপাদন ক্ষমতা ও লভ্যাংশের সংকট অনেক কোম্পানিকে চাপের মুখে ফেলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশে রপ্তানিই এখন চীনা কোম্পানিগুলোর মূল লক্ষ্য।
সাইকেলের দেশ থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ির রাজধানী পর্যন্ত যাত্রা
চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পের বর্তমান গতি এতটাই জোরালো যে, মাত্র দুই দশক আগেও দেশটির কোনো গাড়ি সংস্কৃতি ছিল না—তা ভাবাই কঠিন।
১৯৭০-এর দশকের শেষ দিকে, যখন চীন তার অর্থনীতি বিশ্ববাজারের জন্য উন্মুক্ত করতে শুরু করে, তখন দেশটিতে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সে সময় চীন ছিল "সাইকেলের দেশ" নামে পরিচিত।
পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে ২০০০-এর দশকের শুরুতে, যখন দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফলে কোটি কোটি মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে প্রবেশ করে এবং গাড়ি মালিকানা বেড়ে যায়।
এই সময়েই বহু বিদেশি গাড়ি নির্মাতা—যারা আগেই ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির আশায় বাজারে পা রেখেছিল—চীনে যৌথ উদ্যোগের কোম্পানি গড়ে তোলে স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে। জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানের বড় বড় গাড়ি কোম্পানিকে সরকার বাধ্য করে তাদের প্রযুক্তি ও অভিজ্ঞতা স্থানীয় অংশীদারদের কাছে হস্তান্তর করতে।
তবে চীন বড় পরিসরে গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হলেও, দেশীয় ব্র্যান্ডগুলো দীর্ঘদিন ধরে দ্বিতীয় শ্রেণির হিসেবে বিবেচিত ছিল। এনিয়ে এক টেলিভিশন ডেটিং শোতে এক প্রতিযোগীর বিখ্যাত মন্তব্য ছিল, "সাইকেলে চড়ে হাসার চেয়ে আমি বরং বিএমডব্লিউ-তে বসে কাঁদব।"
কিন্তু ইভি বা বৈদ্যুতিক গাড়ি দ্রুত গ্রহণ করেছে চীনের মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল শ্রেণি। একইসঙ্গে সরকারের বিশাল সহায়তার ফলে আজ সেই চিত্র বদলে গেছে।
২০০৯ সালে, যখন টেসলা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের ঋণ পায়, তখন বেইজিংও পুরোদমে নতুন ধরনের জ্বালানি-চালিত গাড়ি (নিউ এনার্জি ভেহিকল) খাতে পরিকল্পিত বিনিয়োগ শুরু করে।
এই উদ্যোগের আওতায় সরকার পাবলিক বাস ও ট্যাক্সি বহরে ইভি ব্যবহারের জন্য চুক্তি প্রদান করে, চার্জিং অবকাঠামো গড়ে তোলে এবং কর ছাড়, ক্রেতা প্রণোদনা ও ভর্তুকির মতো সুবিধা চালু করে।
এসব ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য রয়েছে। চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম বলছে, এক দশকে সরকারের এই খাতে প্রণোদনার পরিমাণ ছিল আনুমানিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশ্লেষকদের মতে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই ভর্তুকির পরিমাণ ৫ হাজার কোটি থেকে ২০ হাজার কোটি ডলারের মাঝামাঝিও হতে পারে। একই সঙ্গে, ইভি ব্যাটারির কাঁচামাল সংগ্রহে বেইজিং বৈশ্বিক বাজারে আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছে, এবং এখন এই পুরো সরবরাহ চেইনের নিয়ন্ত্রণ প্রায় তাদের হাতে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে খাতটি পর্যবেক্ষণ করা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু শিল্পনীতি নয়, এই অগ্রগতির পেছনে ছিল দূরদর্শী উদ্যোক্তাদের সাহসী প্রবেশও।
বিওয়াইডি–এর প্রতিষ্ঠাতা ওয়াং চুয়ানফুর মতো উদ্যোক্তারাই এই শিল্প বিপ্লবকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওয়্যারেন বাফেটের বিনিয়োগ কোম্পানিটিকে বৈশ্বিক মানচিত্রেও জায়গা করে দেয়।
আজ চীনে বিক্রি হওয়া গাড়ির প্রায় অর্ধেকই ইভি বা হাইব্রিড।
বিদেশি কোম্পানিগুলোর প্রতিকৌশল
ভক্সওয়াগন, টয়োটা, জেনারেল মোটরসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চীনা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রযুক্তি সহযোগিতায় এগিয়ে আসছে। ভক্সওয়াগন গত বছর এক্সপেং- নামক চীনা কোম্পানিতে ৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে, টয়োটা ও জেনারেল মোটরস (জিএম) চীনা প্রযুক্তি ফার্ম মোমেন্টা-র সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।
বাজারে টিকে থাকার এই লড়াইকে বিশ্লেষকরা বলছেন "বিদেশি কোম্পানির পাল্টা আক্রমণ"।
সামনে কী?
যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য উত্তেজনা আরো বাড়তে পারে। ইভিতে ব্যবহৃত সেমিকন্ডাক্টর রপ্তানিতে বিধিনিষেধও আরোপ হতে পারে। এমন অবস্থায় কিছু চীনা কোম্পানি ইতোমধ্যেই বিকল্প ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, বৈশ্বিক অটো শিল্প এখন দুটি ধারায় বিভক্ত হতে পারে—একদিকে চীন নেতৃত্বাধীন বৈদ্যুতিক ভবিষ্যৎ; অন্যদিকে আমেরিকা, যেখানে এখনও "টেইলপাইপ" যুগ চলছে। অর্থাৎ, চীনের গতির সাথে তাল মেলাতে পদে পদে হোঁচট খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি শিল্প।
বর্তমানে চীনে বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির প্রায় অর্ধেকই ব্যাটারিচালিত ইভি বা হাইব্রিড। এর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে এই ধরনের গাড়ির বিক্রির হার এখনো অনেক পিছিয়ে—গত বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে দেশটিতে মোট গাড়ি বিক্রয়ের মাত্র ২০ শতাংশের একটু বেশি ছিল ইভি ও হাইব্রিড, এমনটাই জানিয়েছে মার্কিন জ্বালানি তথ্য প্রশাসন (ইআইএ)।