পাকিস্তানি ট্রাক আর্ট: যেন এক ভ্রাম্যমাণ শিল্পকর্ম

পাকিস্তানের ধুলাময় মহাসড়ক ও শহরের ব্যস্ত সড়কগুলো দিয়ে চলাচল করা ট্রাকগুলো যেন কেবল একটি যানবাহনই নয়, বরং এগুলো যেন একেকটি ভ্রাম্যমাণ শিল্প। যানবাহনগুলোর গায়ে দেখা যায় হরেক রকমের চিত্র, নকশা ও কারুকার্য। এছাড়াও দেখা যায় কবিতা, বাণী ও স্লোগান। শিল্পীর তুলিতে আঁকা এসব নকশা ও কারুকার্যের মধ্য দিয়ে যানবাহনগুলোতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে দেশটির লোকজ সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি।
পাকিস্তানে ট্রাকের গায়ে এই শিল্প চিত্রায়িত করা শুরু হয় ব্রিটিশ শাসনামলে। সে সময় ট্রাক মালিকেরা ফুল, ক্যালিগ্রাফি, মোটিফসহ বিভিন্ন নকশা আঁকিয়ে তাদের ট্রাকগুলো বর্ণিল রঙে সাজাতেন।
শুরুর দিকে এটি ছিল সাধারণ একটি সাজসজ্জার বিষয়। এর পর একসময় তা শিল্পে পরিণত হয়। চিত্রশিল্পী, ওয়েল্ডার, বৈদ্যুতিক মিস্তি, মেকানিকসহ যারা ট্রাক তৈরির কাজ করে থাকেন, তারা সবাই মিলে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত এ যানবাহনগুলোকে এখন আঞ্চলিক পরিচয়ের প্রতীকে রূপান্তরিত করছেন।

বেলুচিস্তান প্রদেশের কিছু ট্রাকে উটের হাড় দিয়ে তৈরি নকশা দেখা যায়, পেশওয়ারের ট্রাকগুলোতে দেখা যায় কাঠের সূক্ষ্ম কারুকাজ। আর রাওয়ালপিন্ডির ট্রাকগুলোতে দেখা যায় ডিস্কো-স্টাইলের নকশা।
রাওয়ালপিন্ডির মুহাম্মদ আশফাক। ৫৫ বছর বয়সি এই ব্যক্তি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ট্রাকে নকশা আঁকাআঁকির কাজ করছেন।
কথা হয় এই শিল্পীর সঙ্গে। তিনি বললেন, 'কাস্টমাররা তাদের ট্রাকে কোন নকশা চিত্রিত করবেন, সে বিষয়ে তাদের নিজস্ব একটা ভাবনা ও বাজেট থাকে। আমরা তাদের কাছে আগে জানতে চাই কোন ধাঁচের নকশা পছন্দ। যেমন- পেশওয়ার, হাজারা, সুয়াত, পিন্ডি, মাণ্ডি বাহাউদ্দিন নাকি করাচি?'

পিন্ডি স্টাইলকে সবচেয়ে রঙিন ও ঝলমলে বলে ধরা হয়। এতে উজ্জ্বল রং, স্টিকার, আয়নার কাজসহ বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়।
ট্রাকচালক ফারুখ সানা সম্প্রতি তার ট্রাকটিতে নকশা আঁকিয়ে নিয়েছেন। তিনি বলেন, 'পিন্ডি স্টাইল দেখে মনে হবে যেন বিয়ের জন্য কনেকে সাজানো হচ্ছে। যখন মানুষ আমাদের ট্রাকের প্রশংসা করে, তখন আমরা গর্ব অনুভব করি। এটা আমাদের কঠোর পরিশ্রম ও সৌন্দর্যের প্রতীক।'
রঙসহ অন্যান্য উপকরণ ও ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে ট্রাকগুলোতে নকশা আঁকানোর খরচও ভিন্ন হয়ে থাকে।
নকশার পাশাপাশি ট্রাকগুলোতে কবিতা, ধর্মীয় বাণী ও বিভিন্ন ধরনের কথা লেখা দেখা যায়। এগুলো চালকদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করে থাকে।

এসব নকশা এখন আর শুধু বড় বড় ট্রাকের গায়েই সীমাবদ্ধ নেই, রিকশা, বাস এমনকি ঘরবাড়ির সাজসজ্জাতেও এ ধরনের নকশা দেখা যায়।
১৯৭০ এর দশকে যখন বিদেশি পর্যটকেরা রঙিন ট্রাকের ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন, সে সময় প্রথমবারের মতো নকশাযুক্ত এসব ট্রাক আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। এরপর থেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতেও এসব ট্রাকের ছবি স্থান পেয়েছে। এমনকি আধুনিক ফ্যাশন ও পণ্যের ডিজাইনেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সংকটের মাঝেও দক্ষিণ এশিয়ার এই অনন্য শিল্প টিকে আছে। আশফাকের মতো শিল্পীরা এখনো তাদের কাজে নিবেদিত, আর সানার মতো চালকেরা তাদের ট্রাককে শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, বরং চলমান সাংস্কৃতিক দূতের মতো মনে করেন।
অনেকটাই গর্বের সঙ্গে সানা বললেন, 'প্রত্যেক চালক চায় তার ট্রাক যেন অন্যদের চেয়ে আলাদা দেখায়। যখন আমরা ট্রাক চালাই আর মানুষ তাকিয়ে থাকে, তখন আমরা বুঝি আমরা বিশেষ কিছু তৈরি করেছি।'




অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক