ভারত-পাকিস্তানের মিম যুদ্ধ

আগে পুরুষরা যুদ্ধে যেত, আর এখন তারা এক্স (পূর্বে টুইটার) ও ইনস্টাগ্রামে যায় মিম শেয়ার করতে। যদি একথা শুনে আপনার বিরক্ত লাগে, তাহলে বলতে হবে আপনি হয়তো আমাদের মতো ইন্টারনেট-নির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত নন, যারা মিম শেয়ার আর ঠাট্টা-তামাশার মধ্যে দিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতির উত্তেজনা অনুভব করছে।
যখন 'পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ' (ফিফথ জেনারেশন ওয়ারফেয়ার) শব্দটি তৈরি হয়েছিল, এর স্রষ্টারা কখনোই ভাবেননি যে একটি দেশের যুদ্ধ কৌশলকে ঠাট্টা করে হাস্যরসাত্মক মিম ও ভিডিওর মাধ্যমে উপস্থাপন করতে এই শব্দটি ব্যবহৃত হবে।
আমরা এখন ২০২৫ সালে আছি। ভারত যখন পাকিস্তানে আক্রমণ করার এবং সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত করে দেশটিতে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে, পাকিস্তানি তরুণরা তখন তার জবাব দিচ্ছে তাদের নিজস্ব স্টাইলে — মিম আর জোকস শেয়ারের মাধ্যমে।
যারা এই মিম বা জোকসগুলো দেখেননি, তারা হয়তো এগুলোকে ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনের বলা 'চা দারুণ ছিল' টাইপ রসিকতা বলে ভাবছেন। এখন এসব ঠাট্টায় আর তেমন হাসি আসে না। এই সময়ের মিমগুলো একেবারে আলাদা।
এসব মিমে তারা নিজেদের (পাকিস্তানের) সমস্যা বা সংকট নিয়ে মজা করে। অনেকটা ক্লাসের দুষ্টু ছেলের মতো, যে নিজের ভুল বা দুরবস্থাকে নিয়ে এমনভাবে মজা করে যে অন্য মানুষ কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে।
শুধু ভারতকে নিয়ে নয়, পাকিস্তানের নিজের সমস্যা; যেমন পানির সংকট বা মোবাইল ফোনে বেশি ট্যাক্স সেগুলো নিয়েও মিম বানানো হচ্ছে।
আসলে অনলাইনে পাকিস্তানিরা এমন সব মিম শেয়ার করছে, যা দেখে অনেক ভারতীয়ও অবাক হয়ে ভাবছে — 'পাকিস্তানের নেট নাগরিকরা এত অংসবেদনশীল হয় কীভাবে?'
মিম কত ধরনের
এগুলো শুধু বিনোদন নয় — এক নতুন ধরনের যুদ্ধ; অস্ত্র নয়, হাসি-ঠাট্টাই যার হাতিয়ার। আসলে দেশটির কেউ সত্যি ভাবছেই না যে ভারত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দিতে পারে বা সত্যিই আক্রমণ করতে পারে। এই মিম আর জোকসগুলো বাস্তব যুদ্ধের আগে করা মজা মাত্র। তবে, যুদ্ধ নিয়ে এমন ব্যঙ্গ হয়তো একমাত্র জেনারেশন জেড-ই করতে পারে!
সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বিষয় হলো — মিমগুলোতে দারুণ বুদ্ধি খাটানো হয়েছে!
কেউ লিখছে, 'যুদ্ধ হলে পাক স্টাডিজ বইয়ে আবার একটা নতুন অধ্যায় যোগ হবে — আফসোস!' আবার কেউ বলছে, 'প্রিয় সেলিব্রেটির জন্য সীমান্তের এপারে পানি পাঠান।'
আরও মজার একটা মিম হলো, 'পিটিএ'র নেটওয়ার্কের সীমার বাইরে গিয়ে ম্যাজিক দিয়ে মোবাইল চালানো হচ্ছে।'
'যদি ভারত পাকিস্তানকে দখল করে, তাহলে হয়তো বাবর আজমকে ভারতীয় ক্রিকেট দলে খেলতে হবে!'-এ নিয়েও মিম দেখা গেছে।
আবার ধরুন একটা দুঃখী বিড়ালের ছবি, সঙ্গে লেখা: 'পানি ছেড়ে দাও, আমার স্কিনকেয়ার করতে হবে!'
এক ভিডিওতে দেখা যায় পাকিস্তানের তরুণ-তরুণীরা পাহাড়ে দৌড়াচ্ছে, কারণ গুজব ছড়িয়েছে: 'ক্যাপ্টেন অজয় দেবগন, মেজর অক্ষয় কুমার আর জেনারেল হৃত্বিক রোশন পাকিস্তানে ঢুকে পড়েছে!'
এমনি ভারতীয়রাও পাকিস্তানিদের এসব মিম দেখে না হেসে পারছে না। কোনো কোনো ভারতীয় এসব মজায় যোগও দিয়েছে। কেউ বলছে, 'আমার প্রিয় পাকিস্তানিকে আমি পানি পাঠাব'।
আবার কেউ প্ল্যান করছে 'যুদ্ধের সময়' করাচির বিখ্যাত বার্নস রোড-এ কাবাব খেতে যাবে, কিংবা অনলাইনে হওয়া পাকিস্তানি বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পাকিস্তানি শহরে ঢুকে পড়বে!
সবাই মিলে যুদ্ধের ধারণাটাকেই এমনভাবে ব্যঙ্গ করছে, যেটা একমাত্র জেন-জিরাই পারে। এটা এমন এক প্রজন্ম যাদের কোনো কিছু সিরিয়াসলি না নেওয়ার জন্য সমালোচনার শেষ নেই।
কিন্তু একটা বিষয় তারা খুবই সিরিয়াসলি করছে। তা হলো যুদ্ধের মতো ভয়ংকর একটা বিষয় নিয়ে মজা করে, পাকিস্তানিদের যুদ্ধের সম্ভাবনাকেই তারা অকার্যকর করে দিচ্ছে!
বিষয়গুলোকে সিরিয়াসলি না নেওয়ার অভ্যাস, সঙ্গে সমাজ আর রাষ্ট্র নিয়ে হতাশা, আর সবকিছু নিয়ে জোকস বানানোর প্রবণতা — সব মিলিয়ে মিম বানানোর একেবারে পারফেক্ট রেসিপি!
'দিনে একটা মিম খাও, যুদ্ধ চেতনা দূরে হঠাও!'
সংকটের সময় মিম ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। পাকিস্তানের ওপর যা-ই আসুক না কেন, এখানকার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা অধিকাংশক্ষেত্রেই মিম আর আত্ম-অবমাননাকর রসিকতা করে তার জবাব দেয়।
তা হোক ক্রিকেটে হার কিংবা সত্যিকারের যুদ্ধের হুমকি; সব ক্ষেত্রেই মিম একমাত্র সমাধান। পাকিস্তানিরা নিজেদের মিম গেম নিয়ে শুধু গর্বই করে না, অন্যদের বাজে রসবোধ নিয়ে টিপ্পনিও কাটে।
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হন। ভারত সরাসরি এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে। পাকিস্তান অবশ্য দায় অস্বীকার করে।
কিন্তু ভারত পাকিস্তানে বিমান হামলা চালায়। তবে সেই হামলায় কোনো প্রাণহানি হয়নি।
ভারতীয় বিমান বাহিনীর পাইলট ক্যাপ্টেন অভিনন্দন পাকিস্তানি সীমান্তে ঢুকে পড়ার পর তার বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা এবং তাকে আটক করার ঘটনাটি ভারতের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা ছিল।
তবে পরে পাকিস্তান দ্রুতই তাকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তার আগেই তাকে এক কাপ চা খাওয়ানো হয় — তার (অভিনন্দন) ভাষায় সেই চা ছিল 'ফ্যান্টাস্টিক'! পরবর্তীতে এই 'ফ্যান্টাস্টিক চা'-কথাটাই হয়ে যায় এক বিশাল মিম, যার ঢেউ আজও ইন্টারনেটে চলমান।
সেসময় পরিস্থিতি সত্যিই বেশ উত্তপ্ত ছিল — কারণ দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়া কোনো হাসি-মশকরার বিষয় নয়। তবুও তখনকার বেশিরভাগ ঠাট্টা-মশকরা শুরু হয়েছিল সরাসরি যুদ্ধের আশঙ্কা অনেকটাই কেটে যাওয়ার পর।
তবে ২০১৯ সালের সেই মিম শেয়ারকারীরাও হয়তো কল্পনা করতে পারেনি, ২০২৫ সালে এসে পাকিস্তানিরা এতটাই 'আনসিরিয়াস' হয়ে যাবে- যে তারা এমন একটা সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়েও ঠাট্টা করবে।
এমনকি এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি (সিন্ধু পানিচুক্তি) স্থগিত হওয়া নিয়েও তারা মজা করছে, যেটা দেশটির কোটি কোটি মানুষের জীবিকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একেকটা মিম যেন একেকটা থেরাপি
নিজেদের নিয়ে মজা করে হাসা বা নিজেকে ব্যঙ্গ করে ঠাট্টা করা, শুধু পাকিস্তানিরাই এমন করে তা নয়।
মানুষ বহু বছর ধরেই হাস্যরসকে মানসিক চাপ কাটানোর একটা উপায় হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। তবে যুদ্ধের মতো ভয়ানক বিষয় নিয়ে একের পর এক মিম বানিয়ে ব্যঙ্গ করার বিষয়টা হয়তো পাকিস্তানের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে।
জেনারেশন-জেডকে নিয়ে করা বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, তারা আগের প্রজন্মগুলোর চেয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ও হতাশাগ্রস্ত।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, আজকালকার তরুণদের মধ্যে বিষন্নতা বড় একটা সমস্যা। এমনকি অনেকের কাছে নিজের মানসিক স্বাস্থ্যই একটা টেনশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই ধরনের হাস্যরসকে কেউ কেউ বলে 'গ্যালোস হিউমার', মানে বিপদের মুখে হাসা।
এই সময়ে পাকিস্তান ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুতের দাম আকাশছোঁয়া, করাচিতে পানির সংকট; দেশটির সব জায়গায় গ্যাস একটা বড় সমস্যা। পাকিস্তানে মোবাইল ব্যবহারকারীদের পিটিএ-কে মোটা অঙ্কের ট্যাক্সের বিল দিতে হয়। এই অবস্থার মধ্যে মানুষ চাকরি পাচ্ছে না, আর সারাদেশে এক ধরনের ভয় আর অনিশ্চয়তা তো আছেই।
তাহলে এখানকার মানুষ হতাশাগ্রস্ত না হয়ে কী হবে? তাই পাকিস্তানিরা এখন হাস্যরসকেই বেছে নিচ্ছে মানসিক শান্তির একমাত্র ভরসা হিসেবে!
ইসলামাবাদে আন্দোলনকারীদের ঢুকতে বাধা দেওয়ার জন্য রাখা কনটেইনারে উঠে কেউ লাফালাফি করছে — আর সেই ভিডিওতে কেউ আবার ভিডিও গেমের হাস্যকর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক যোগ করছে! আর ভিপিএন নিয়ে চিরাচরিত রসিকতা তো আছেই। সব মিলিয়ে পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম অনেক গুরুতর বিষয়কেই মিমে পরিণত করছে।
এমন না যে তারা সমস্যাগুলির তীব্রতা বুঝতে পারছে না, বরং আসল ব্যাপার হলো, এত বড় বড় ঘটনা, এত চাপ — তারা বুঝে উঠতে পারছে না এসব সামলাবে কীভাবে। তাই তারা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে বেছে নিচ্ছে মানসিক স্বস্তির একটি হাতিয়ার হিসেবে।
এটি কি চাপ মোকাবিলার কোনো স্বাস্থ্যকর উপায়?
সম্ভবত না। তবে এটি এক ধরনের ডার্ক হিউমার, যেটা চরম মানসিক চাপে থাকা মানুষদের মধ্যে একধরনের একতা তৈরি করে এবং কঠিন আবেগ সামাল দিতে সাহায্য করে।
এমন রসিকতা সাধারণত দেখা যায় ডাক্তার, সাংবাদিক, পুলিশ সদস্য এমনকি যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে — যারা প্রায়ই নিজেদের মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করতে এইভাবে ঠাট্টা-রসিকতার আশ্রয় নেয়।
তবে পেশা যাই হোক না কেন, এখন পাকিস্তানিদের জীবনে চাপ এত বেশি যে, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে।
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে
তবে একটা কথা স্পষ্টভাবে বলা যায়, আজকের তরুণ পাকিস্তানিরা যতই কৌতুক করুক, তাদের মানসিক দৃঢ়তা এবং অন্ধভাবে প্রতিবেশী দেশকে ঘৃণা না করার মনোভাব সত্যিই প্রশংসনীয়।
ভারত যতই যুদ্ধংদেহী বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিক না কেন, পাকিস্তানিরা যে গভীর হাস্যরস-বেষ্টিত বর্ম পরে আছে, তা ভেদ করতে পারবে বলে মনে হয় না।
পাকিস্তান যেন ক্লাসের পিছনের সারির সেই উদাসীন ছাত্রটা, যে সবচেয়ে অপ্রাসঙ্গিক সময়েও মজার কথা বলে বসে। অথবা সেই ২০০০ দশকের সিনেমার মজার বন্ধু চরিত্র, যে সবসময় হাসির হাসির কথা বলে, অপমান করলেও কাঁধ ঝাঁকিয়ে হেসে উড়িয়ে দেয়।
পাকিস্তানের বহু মানুষ যখন ভাবছে এই সাম্প্রতিক উত্তেজনা কি সত্যিই যুদ্ধে গিয়ে ঠেকবে? তখন অন্যদিকে অনেকে ইনস্টাগ্রামে স্ক্রল করতে করতে ভিডিওতে দেখছে, ভারতীয় সেনা পাকিস্তানে ঢুকে বিশাল ঋণের বোঝা আর সমস্যার ভেতর পড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এভাবেই তারা নিজের দেশকেই নিয়ে ঠাট্টা করছে।
এই ধরনের ঠাট্টা-রসিকতা শুধু হাসির খোরাকই জোগায় না, বরং এক ধরনের মানসিক স্বস্তিও এনে দেয়।
পাকিস্তানে কোনো ভয়ভীতি বা সহিংসতার আহ্বান নেই- শুধু একটা আশ্বাস আছে যাই হোক না কেন, যে সব ঠিক হয়ে যাবে।