পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও নতুন পোপ নির্বাচন যেভাবে

ভ্যাটিকানের কাসা সান্তা মার্তায় নিজ বাসভবনে মারা গেছেন পোপ ফ্রান্সিস (৮৮)। আজ সোমবার (২১ এপ্রিল) ভ্যাটিকান তার মৃত্যুর কথা জানায়।
পোপের মৃত্যুর পর রোমান ক্যাথলিক চার্চ সাধারণত তাদের ঐতিহ্যগত রীতি ও আচার পালন করে থাকে। পোপ ফ্রান্সিসের ক্ষেত্রেও সেটা করা হবে।
বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে পোপ ফ্রান্সিসকে বিদায় ও নতুন পোপ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। এসব রীতি ও আচারের বেশিরভাগই এসেছে তাদের ইউনিভার্সি ডোমিনিসি গ্রেগিস নামের সংবিধান থেকে।
পোপ না থাকার এই সময়কে সময়কে বলা হয় 'সেদে ভ্যাকান্তে' বা শূন্য আসন। এই সময়ে চার্চের দৈনন্দিন কাজকর্ম দেখভাল করেন ক্যামেরলেনগো (চেম্বারলেন) নামে পরিচিত একজন কার্ডিনাল। বর্তমানে এই দায়িত্বে আছেন আইরিশ-মার্কিন কার্ডিনাল কেভিন ফ্যারেল। তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পোপের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে থাকেন।
সাধারণ মানুষ যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন, সেজন্য পোপের দেহ কখন সেন্ট পিটার্স বাসিলিকায় নেওয়া হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন কার্ডিনাল ইলেক্টরেরা। এ দলে ক্যারেলেনগোসহ আরও তিন কার্ডিনাল থাকেন, যাদের বয়স ৮০ বছরের নিচে।
সদ্য প্রয়াত পোপের বিশেষ আংটি (ফিশারম্যান'স রিং) ও তার সিল যাতে আর কেউ ব্যবহার করতে না পারেন, সেজন্য সেগুলো ভাঙা বা নষ্ট করা হয়েছে কি না, সেটিও তারাই নিশ্চিত করেন। পোপের মরদেহের ময়নাতদন্ত করা হয় না।
আরও পড়ুন: ৮৮ বছর বয়সে মারা গেলেন পোপ ফ্রান্সিস
ক্যামেরলেনগো পোপের মৃত্যুর পর তার ব্যক্তিগত কক্ষ তালাবদ্ধ করে সিল করে দেন। আগে পোপেরা অ্যাপোস্টোলিক প্যালেসের অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস ভ্যাটিকানের অতিথিশালা সান্তা মার্তা-তে একটি ছোট স্যুটে থাকতেন।
ক্যামেরলেনগো ও অন্য কার্ডিনালরা চার্চের জন্য বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বা ধর্মীয় শিক্ষায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন না।
পোপের মৃত্যুর পর ভ্যাটিকানের বেশিরভাগ দপ্তরের প্রধানরা পদত্যাগ করেন। এরপর নতুন পোপ পুনরায় তাদের অথবা তাদের জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগ দেন।
পোপের মৃত্যুতে নয় দিন ধরে শোক পালন করা হয়। পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও সমাহিদ করার তারিখ কার্ডিনালরা ঠিক করেন।
পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
ঐতিহ্যগতভাবেই পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে থাকে। তবে পোপ ফ্রান্সিস অতিরিক্ত জাঁকজমকপূর্ণ কিছু পছন্দ করতেন না এবং পোপ হিসেবে তিনি বিশেষ সুবিধাগুলোও এড়িয়ে চলতেন। গত বছর তিনি পোপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রীতিনীতি পরিবর্তন আনেন এবং এটি আরও সহজ করেন।
পোপের শেষকৃত্য সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে হওয়ার কথা। তবে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন তাকে যেন রোমের সেন্ট মেরি মেজর বাসিলিকায় সমাহিত করা হয়। কারণ সেখানে তার প্রিয় ম্যাদোনার মুর্তি অবস্থিত।
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা সংকটে সহানুভূতির বার্তা নিয়ে ঢাকায় আসেন পোপ ফ্রান্সিস
প্রয়াত পোপকে সাইপ্রাস, সীসা ও ওক কাঠের তিন স্তরের কফিনে সমাহিত করার প্রথা ছিল। কিন্তু পোপ ফ্রান্সিস চেয়েছেন যেন তাকে একটি সাধারণ কাঠের তৈরি কফিনে সমাহিত করা হয়।
এছাড়াও মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য পোপের মরদেহ সাধারণত সেন্ট পিটার্স বাসিলিকায় একটি উঁচু মঞ্চে (ক্যাটাফাল্ক) রাখা হতো। তবে পোপ ফ্রান্সিস অনুরোধ করেছেন যেন তার দেহ ক্যাটাফাল্কে রাখা না হয়।
যেভাবে নতুন পোপ নির্বাচিত হন
পোপের মৃত্যুর পর সারাবিশ্বের কার্ডিনালরা রোমে আসেন। তারা প্রতিদিন বৈঠক করেন। বৈঠকে চার্চের বিভিন্ন বিষয় ও নতুন পোপের মধ্যে কী ধরনের গুণাবলি থাকা উচিত, তা নিয়ে আলোচনা হয়।
যেসব কার্ডিনালের বয়স ৮০ বছর বা এর বেশি, তারা সাধারণ সভাগুলোতে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য হওয়া বিশেষ বৈঠকে (কনক্লেভ) অংশ নিতে বা ভোট দিতে পারেন না। এ বৈঠকে কেবল ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরাই অংশ নিতে পারেন। এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সিস্টিন চ্যাপেলে।
কঠোর গোপনীয়তার মধ্য পরবর্তী পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। কনক্লেভে অংশ নেওয়া কার্ডিনালরা এই সময়টাতে বাইরের কারো সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারেন না। এমনকি এই সময়টাতে তাদের মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ব্যবহার ও সংবাদপত্র পড়াও নিষিদ্ধ।
কনক্লেভের প্রথম দিন একবার ভোট হয়। এরপর প্রতিদিন দুবার করে ভোট দেন কার্ডিনালরা
নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য একজন প্রার্থীর দুই-তৃতীয়াংশের চেয়ে একটি ভোট বেশি পেতে হয়। যদি ১৩ দিনের মধ্যে কেউ নির্বাচিত না হন, তাহলে শীর্ষ দুই প্রার্থীর মধ্যে রান-অফ ভোট হয়।
যেভাবে নতুন পোপের নাম ঘোষণা করা হয়
যখন কনক্লেভে একজন পোপ নির্বাচিত হন, তখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কি না এবং পোপ হিসেবে তিনি কোন নাম নিতে চান। যদি তিনি না বলেন, তাহলে পুরো ভোটপ্রক্রিয়া আবার শুরু হয়।
আরও পড়ুন: পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুতে প্রধান উপদেষ্টার শোকপ্রকাশ
নতুন পোপ সাদা পোশাক পরেন। এরপর তিনি সিস্টিন চ্যাপেলে একটি সিংহাসনে বসেন এবং অন্য কার্ডিনালরা তার কাছে গিয়ে শ্রদ্ধা জানান ও আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।
নতুন পোপ নির্বাচিত হলে ব্যালট পেপারের সঙ্গে বিশেষ কেমিক্যাল পুড়িয়ে সিস্টিন চ্যাপেলের চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া বের করা হয়। তখনই বিশ্ব জানতে পারে পোপ নির্বাচিত হয়েছেন। আর যদি ভোটের ফলাফল না আসে, তাহলে কালো ধোঁয়া বের হয়।
এরপর কার্ডিনালদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে জে্যষ্ঠ (বর্তমানে ফরাসি কার্ডিনাল দোমিনিক ম্যামবার্তি) তিনি সেন্ট পিটার্স বাসিলিকায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে চত্বরে থাকা মানুষের সামনে ঘোষণা করেন, "হ্যাবেমাস পাপাম" (আমাদের একজন পোপ আছেন)। তার এই ঘোষণার পর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন নতুন পোপ।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক