স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কি ‘সর্বকালের সেরা ও ঐতিহাসিক’ নির্বাচন সম্ভব?
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, তার সরকার বাংলাদেশের আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে 'সর্বকালের সেরা এবং ঐতিহাসিক' করার পরিকল্পনা করছে।
গত ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়েজিয়ান রাষ্ট্রদূত হাকোন আরাল্ড গুলব্রান্ডসেনের সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান বলেন, 'আমরা এটাকে একটা দৃষ্টান্ত, একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করতে চাই।'
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে তিনি একই প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
তবে মাঠের বাস্তবতা এমন সব নজিরবিহীন চ্যালেঞ্জ সামনে আনছে, যা অতীতের কোনো নির্বাচনে দেখা যায়নি। তার এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ দেওয়াকে এখন এক কঠিন কর্মযজ্ঞ বলেই মনে হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থার কারণে জনগণ এখনো আশ্বস্ত হতে পারছে না যে সরকার নির্বাচনকে 'সর্বকালের সেরা এবং ঐতিহাসিক' করতে পারবে। তাই জনমনে সংশয় প্রবল।
প্রথম আলোর সাম্প্রতিক এক জনমত জরিপ অনুযায়ী, মাত্র ৫০ শতাংশ মানুষ আশাবাদী যে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে।
এই প্রেক্ষাপটে, গত ১৮ ডিসেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় দুই দৈনিক—দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো—কার্যালয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর এক আতঙ্কজনক প্রভাব ফেলেছে।
পরদিন এক জরুরি বৈঠক থেকে সম্পাদক পরিষদ এবং নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (নোয়াব) গভীর উদ্বেগ এবং তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে।
যৌথ বিবৃতিতে সংগঠন দুটি বলে, 'এই হামলা কেবল গণমাধ্যমের ওপর নয়, বরং আমাদের সমাজ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ওপরও আঘাত। চূড়ান্ত বিচারে এটি খোদ বাংলাদেশের ওপরই হামলা।'
সুশীল সমাজের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠন এই মব বা উশৃঙ্খল জনতাকে থামাতে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়ী করেছেন। পরদিন এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা জনগণকে সব ধরনের মব বা সংঘবদ্ধ সহিংসতা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান।
কিন্তু এই হামলার পর সবাই যে বার্তাটি পাচ্ছে তা হলো—কেউই নিরাপদ নয়। কোথাও কোনো রেড লাইন বা সীমারেখা টানা নেই। পুরো পথটিই যেন ল্যান্ডমাইনে ভরা।
গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিকদের গ্রাস করেছে মব হামলার আতঙ্ক। যে সাংবাদিকরা সত্য খোঁজেন এবং মানুষের সামনে সত্য তুলে ধরেন, তারা এখন নিজেদের এতটা অরক্ষিত মনে করছেন, যা আগে কখনো হয়নি।
দেশে যখন নির্বাচনী হাওয়া বইছে, তখন কি তারা সত্য উদঘাটন করতে এবং নির্বাচনী প্রতিবেদনের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে সেই সত্য তুলে ধরতে নিরাপদ বোধ করবেন? নির্বাচন চলাকালে গণমাধ্যম কি তাদের ওপর অর্পিত 'ওয়াচডগ' বা পাহারাদারের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারবে?
প্রার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের হলফনামা ও নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব দাবি করবে, তা তদন্ত করতে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ও নির্বাচনী দুর্নীতি উন্মোচন করতে কি তারা নিরাপদ বোধ করবেন? সংসদ সদস্য হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদের অতীত ও পটভূমি যাচাই-বাছাই করতে কি তারা নিরাপদ বোধ করবেন? সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা তদন্ত ও প্রকাশ করতে কি তারা নিরাপদ বোধ করবেন? টাকা ও পেশিশক্তি ব্যবহার করে নির্বাচন প্রভাবিত বা কারচুপির যেকোনো চেষ্টা উন্মোচন করতে কি তারা নিরাপদ বোধ করবেন? নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য ছড়ানো ভুল তথ্য ও অপপ্রচার যাচাই করতে এবং এর নেপথ্যের কারিগরদের মুখোশ উন্মোচন করতে কি তারা নিরাপদ বোধ করবেন? তারা যদি এটা করতে ব্যর্থ হন, তবে ভোটাররা সঠিক ও অর্থবহ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য কোথা থেকে পাবেন? পেশাগত কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ঝুঁকি ও সংকট থাকা সত্ত্বেও, মানুষ কি এখনো আশা করে যে নির্বাচনের সময় সাংবাদিকরা স্বাধীন সাংবাদিকতা চালিয়ে যাবেন?
বিরাজমান এই পরিস্থিতি একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে: স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া কি 'সর্বকালের সেরা ও ঐতিহাসিক' নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব? দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে একই উত্তর দেবেন: 'না'।
বাস্তবতা হলো, তারা তাদের অসংখ্য গবেষণায় বারবার দ্ব্যর্থহীনভাবে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।
ইউনেস্কোর মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার রক্ষা করা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য; যখন তথ্য সঠিক, ব্যাপক ও সহজলভ্য হয়, তখনই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু থাকে এবং গণতন্ত্র বিকশিত হয়।
কিন্তু স্বাধীন গণমাধ্যমের অনুপস্থিতিতে এই কাজটি কে করবে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ক্রমাগত বলে আসছেন, বাংলাদেশ এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে এক ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে আছে; গত বছরের আগস্টে এক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর এই নির্বাচন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ সুগম করবে।
গত কয়েক মাস ধরে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ছিল। গত ১১ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সেই অনিশ্চয়তা অনেকটাই কমেছে। কিন্তু তফসিল ঘোষণার ঠিক পরদিন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে লক্ষ্য করে গুলি এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যু, নির্বাচনে প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
নাগরিক স্বাধীনতা থেকে শুরু করে অর্থনীতি, কর্মসংস্থান তৈরিতে নতুন বিনিয়োগ থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ—সবকিছুই নির্ভর করছে আসন্ন নির্বাচনের মানের ওপর। নির্বাচন যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে বাংলাদেশ তার অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় সংসদ, বিচার বিভাগ, পুলিশ ও প্রশাসনের মতো মূল প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠনের সুযোগ পাবে।
তাই আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও গণভোট বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর ফলাফলই দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো প্রায়ই স্বাধীন গণমাধ্যমকে 'নির্বাচনের অক্সিজেন' হিসেবে অভিহিত করেন, এটা বোঝাতে যে তথ্যের 'নির্মল বাতাস' ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না। স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়া গণতান্ত্রিক নির্বাচন আয়োজনের কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বাংলাদেশ এখন কী করবে? স্বাধীন গণমাধ্যম ছাড়াই কি 'সর্বকালের সেরা ও ঐতিহাসিক' নির্বাচনের পথে হাঁটবে দেশ? নাকি সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর অনিশ্চয়তার খড়্গ ঝুলিয়েই রাখবে?
নাকি আগামী ফেব্রুয়ারিতে 'সর্বকালের সেরা ও ঐতিহাসিক' নির্বাচন আয়োজনে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার যুগান্তকারী কোনো পদক্ষেপ নেবে? বল এখন সরকারের কোর্টে।
