ইউক্রেন প্যাট্রিয়ট মিসাইল কিনতে চাওয়ায় সব ফ্রন্টে চাপ বাড়াচ্ছে রাশিয়া

গত এক সপ্তাহে রুশ হামলায় বহু বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। এর মধ্যে, বুধবার (১৬ এপ্রিল) রাতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর ডিনিপ্রোতে চালানো এক হামলায় এক শিশুসহ অন্তত তিনজন নিহত হন।
এই ড্রোন হামলা এমন সময়ে চালানো হলো, যখন আজ বৃহস্পতিবার প্যারিসে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এই বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ। তারা ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ এবং অন্যান্য ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করবেন।
ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির চিফ অব স্টাফও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনার জন্য প্যারিসে অবস্থান করছেন।
এদিকে, রাশিয়ার ঘোষিত ৩০ দিনের জ্বালানি অবকাঠামোর ওপর হামলা থেকে বিরত থাকার সময়সীমা শেষ হতে চলেছে। তবে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনায় এখনও তেমন অগ্রগতি দেখা যায়নি।
রাশিয়া তাদের কড়া অবস্থানে অটল রয়েছে এবং ইউক্রেনকে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গের অভিযোগ করেছে, যদিও কিয়েভ শুরু থেকেই এই চুক্তিতে সম্মত হয়নি।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, 'এই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনী মানেনি এবং এখনো মানছে না।'
রাশিয়া দাবি করেছে, ইউক্রেন ওই দিন ব্রায়ানস্ক অঞ্চলের একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র ও একটি হাই-ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন, ইউক্রেন অধিকৃত খেরসনের একটি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র এবং কুরস্ক অঞ্চলের দুটি গ্যাস পাইপলাইনের ওপর ড্রোন হামলা চালিয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ১৮ মার্চের জ্বালানি যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০ মার্চের পূর্ণ যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের পাল্টা পদক্ষেপ। ট্রাম্পের প্রস্তাবে ইউক্রেন সম্মতি জানালেও পুতিনের প্রস্তাবে রাজি হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত দুটি পৃথক যুদ্ধবিরতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে—একটি মস্কোর সঙ্গে, অন্যটি কিয়েভের সঙ্গে।
ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফ গত সপ্তাহে জানায়, 'আজ এক মাস পূর্ণ হলো, রাশিয়ান ফেডারেশন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত পূর্ণ ও নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি প্রত্যাখ্যান করেছে।' তাদের মতে, এই সময়ে রাশিয়া ৫ হাজার ১২৪টি স্থল হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৩ হাজারেরও বেশি হামলা হয়েছে দোনেৎস্ক অঞ্চলের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায়—পোকরভস্ক, তোরেতস্ক ও লাইমানে।
এদিকে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি টেলিগ্রামে লিখেছেন, 'এপ্রিলের শুরু থেকেই রুশ বাহিনী প্রায় ২ হাজার ৮০০টি বিমান হামলা চালিয়েছে।'
যুক্তরাষ্ট্র এখন শুধু দুটি ব্যর্থ যুদ্ধবিরতির মাঝখানেই পড়েনি, বরং তাদের করা 'যুদ্ধবিরতির পর ইউক্রেনকে বিভক্ত করার' প্রস্তাবকেও অস্বীকার করছে।
ব্রিটিশ দৈনিক 'দ্য টাইমস' জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন-বিষয়ক বিশেষ দূত কিথ কেলগ একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বার্লিনের মতো ইউক্রেনকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভাগ করে নেওয়ার কথা বলা হয়।
তবে কেলগ বলেছেন, দ্য টাইমস-এ তার প্রস্তাব ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। তার প্রকৃত প্রস্তাব ছিল 'একটি মিত্র বাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ অঞ্চল নির্ধারণ'-সংক্রান্ত, যেখানে মার্কিন সেনারা থাকবে না এবং যা ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে সহায়ক হবে।
তবু শুক্রবার আলমাতিতে কমনওয়েলথ স্বাধীন রাষ্ট্র (সিআইএস) সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ বলেন, 'জেলেনস্কি যে ১৯৯১ সালের সীমান্তে ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়ে যাচ্ছেন, তা কখনোই সম্ভব নয়।'
এমনকি বার্লিন-ধরনের দখল ব্যবস্থা গড়ে তোলার কেলগের প্রস্তাবও রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ রাশিয়া আগেই জানিয়ে দিয়েছে, তারা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ন্যাটো সেনা মোতায়েন কখনোই মেনে নেবে না।
রাশিয়ার বিশেষ দূত রোডিওন মিরোশনিক শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, সামরিক দখলের ভিত্তিতে এলাকা ভাগাভাগি ভবিষ্যতে 'নতুন ধরনের উত্তেজনা' সৃষ্টি করবে।
এই মতবিরোধের প্রেক্ষিতে, ক্রেমলিনের মুখপাত্র পেসকভ বলেন, তাৎক্ষণিক কোনো সমাধান আশা করা 'প্রায় অসম্ভব'।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বৃদ্ধি
এদিকে ইউক্রেনে হামলার মাত্রা আরও বাড়িয়েছে মস্কো। ইউক্রেন জানিয়েছে, মঙ্গলবার জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে রাশিয়া এক ব্যাটালিয়ন শক্তির সাঁজোয়া যান ও পদাতিক বাহিনী দিয়ে আক্রমণ চালায়।
ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় বাহিনীর মুখপাত্র ভ্লাদিসলাভ ভলোশিন বলেন, ফ্রন্টলাইন থেকে আট কিলোমিটার দূরে ওরিখিভে হামলার চেষ্টা করার সময় রুশ ইউনিটটি ধ্বংস হয়ে যায়। দক্ষিণ ফ্রন্টে ৪০০-৫০০ সেনা নিয়ে এ ধরনের আক্রমণ বিরল।
ওরিখিভ অঞ্চলে উভয় পক্ষই আগেও সফল অভিযান চালিয়েছে। ২০২৩ সালে ইউক্রেন পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে অঞ্চলটির কিছু অংশ পুনর্দখল করলেও, গত বছর রাশিয়া আবারও এর বেশিরভাগ এলাকা দখল করে নেয়।
ইউক্রেন জানায়, ডোনেৎস্ক-জাপোরিঝিয়া সীমান্তের ভেসেলে ও স্কুদনের দিকে আরও একটি বড় আকারের হামলা হয়েছে, যেখানে রাশিয়া পাঁচটি ট্যাংক ও ২০টি সাঁজোয়া যান ব্যবহার করেছে।
সামাজিক মাধ্যমে ইউক্রেনীয় কমান্ডার সের্হিই নাইয়েভ দাবি করেন, 'আরও বেশি সেনা ও সরঞ্জাম ব্যবহার করা হচ্ছে… চার সারিতে করে প্যারাট্রুপার আনা হয়। সেগুলোও ধ্বংস করা হয়েছে।'
তিনি জানান, এতে কমপক্ষে ১০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে।
প্যাট্রিয়ট কিনতে আগ্রহী ইউক্রেন
রাজনৈতিক কূটনীতিতে একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি এসেছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির কাছ থেকে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনুদান চাওয়ার পরিবর্তে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সমুন্নত করতে ১০টি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপনাস্ত্র কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন।
১৩ এপ্রিলে রাশিয়ার একটি হামলাই ছিল এই প্রস্তাবের পেছনে মূল অনুঘটক। সেদিন সুমি শহরে রাশিয়া দুটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যাতে ৩৫ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হন।
দমকল কর্মীরা বোমা বিধ্বস্ত গাড়ি থেকে মরদেহ কেটে বের করে। সেদিন হামলার আশপাশের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল মৃতদেহ। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দাদের মতে, হামলায় ব্যবহৃত হয়েছিল ইস্কান্দার-এম/কেএন-২৩ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র।
কিয়েভে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের দূত ব্রিজেট ব্রিঙ্ক স্বীকার করেছেন, ওই হামলায় রাশিয়া ক্লাস্টার ওয়ারহেড ব্যবহার করেছে।
তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, এটি বেসামরিকদের ওপর নির্বিচার হামলা ছিল না; বরং ইউক্রেনের সিভেরস্ক অপারেশনাল-ট্যাকটিক্যাল গ্রুপের কমান্ড স্টাফদের এক সভাস্থলকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছিল।
তারা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে যে, এমন সামরিক সভা বেসামরিক পরিবেশে আয়োজন করে সাধারণ মানুষকে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
৪ এপ্রিল ইউক্রেনের ক্রিভি রিহ শহরে ২০ জন বেসামরিক নিহত হওয়ার পর রাশিয়া একই ধরনের দাবি করেছিল।
ইউক্রেনের জেনারেল স্টাফ জানিয়েছে, সুমি শহরে ব্যালিস্টিক হামলার পর, অভিযুক্ত রুশ ব্রিগেডের কয়েকটি স্থাপনায় কুরস্ক অঞ্চলে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন।
সুমি হামলার দু'দিন পর ওডেসা সফরের সময় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটেকে বলেন, তারা শুধু প্যাট্রিয়ট চাইছেই না—বরং কেনার জন্য প্রস্তুত।
জেলেনস্কির বক্তব্য ছিল, 'আমরা কেবল প্যাট্রিয়ট চাইছি না, আমরা এগুলো কিনে নিতে প্রস্তুত।'
ইউক্রেনীয় বিমানবাহিনীর মুখপাত্র ইউরি ইগ্নাট গত সপ্তাহে এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বলেন, যুদ্ধ চলাকালে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার ১৩৭টি উদাহরণ প্রমাণ করে যে, 'বর্তমানে কেবল প্যাট্রিয়ট সিস্টেমই এসব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম।'
তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের কাছে প্যাট্রিয়ট বিক্রি করবে কি না, সে বিষয়ে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত 'কনট্যাক্ট গ্রুপ' থেকে সরে দাঁড়ায়—যেটি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে ৫০টি দেশের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল।
তবে শুক্রবারও গ্রুপের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি অব্যাহত রেখেছে।
জার্মানি ঘোষণা দিয়েছে, তারা চারটি আইআরআইএস-টি স্বল্পপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ১২০টি হাতে বহনযোগ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং প্যাট্রিয়টের জন্য ৩০টি ইন্টারসেপ্টর ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করবে।
ডেনমার্ক জানিয়েছে, ২০২৭ সাল পর্যন্ত তারা ইউক্রেনকে ১.১ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সামরিক সহায়তা দেবে, যার মধ্যে থাকবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, কামান ও গোলাবারুদ।
যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে যৌথভাবে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, যার আওতায় যানবাহন মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, রাডার, অ্যান্টিট্যাংক মাইন এবং 'লক্ষ লক্ষ ড্রোন' সরবরাহ করা হবে। পাশাপাশি, নরওয়ে একটি নতুন ইউক্রেনীয় ব্রিগেড গঠনের জন্য অতিরিক্ত ৯৩৮ মিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ন্যাটো প্রধান রুটে জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে মোট ২৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রপ্রধান কায়া কালাস জানান, ২০২৫ সালে এখন পর্যন্ত ইইউ সদস্য রাষ্ট্রগুলো মোট ২৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, যেখানে ২০২৪ সালে এই অঙ্ক ছিল ২০ বিলিয়ন ইউরো।