ইসরায়েলের হামলায় বন্ধ হয়ে গেল গাজার সর্বশেষ সচল হাসপাতাল; বাড়ছে হামলার তীব্রতা

ইসরায়েলি বিমান হামলায় গাজার সর্বশেষ সচল হাসপাতালটি অচল হয়ে পড়েছে। রোববার (১৩ এপ্রিল) ভোরের এ হামলার মাধ্যমে এ অঞ্চলে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের পরিসর ও তীব্রতা আরও বেড়েছে।
হামলায় আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালের জরুরি বিভাগ ও রিসেপশনসহ কিছু অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিএনএনের পাওয়া একটি ভিডিওর বরাতে জানা গেছে, হাসপাতালের সঙ্গে থাকা সেন্ট ফিলিপ'স গির্জাটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তারা হামাসের ব্যবহৃত 'একটি কমান্ড ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র' লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। যদিও এর কোনো প্রমাণ তারা উপস্থাপন করেনি।
আইডিএফ আরও দাবি করেছে, হামলার আগে বেসামরিক লোকজনের ক্ষতি কমানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, হাসপাতালটি সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছিল না।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এখন গাজার আরও গভীরে স্থল অভিযান চালাচ্ছে। এতে গাজা ভূখণ্ড ও ইসরায়েলি সীমান্তের মাঝে একটি বড় বাফার অঞ্চল তৈরি হচ্ছে। আর সেই সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ভূমধ্যসাগর উপকূলে ক্রমেই ছোট হতে থাকা একটি এলাকায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
দক্ষিণে সেনাবাহিনী ঘোষণা করেছে, তারা মোরাগ করিডোর দখল করেছে। ফলে রাফা শহর গাজার বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রোববার রাতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আইডিএফ 'মোরাগ করিডরের দখল সম্পন্ন করেছে' এবং অঞ্চলটিকে 'ইসরায়েলি নিরাপত্তা অঞ্চলের অংশ' হিসেবে ঘোষণা করেছে।
মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গাজার উত্তর সীমান্তও এখন 'নিরাপত্তা অঞ্চলের' অংশ হিসেবে আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেছেন, 'গাজার ভূখণ্ডের বহু শতাংশই এখন ইসরায়েলের নিরাপত্তা অঞ্চলের অংশ হয়ে গেছে।'
তিনি আরও দাবি করেন, 'প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, জিম্মি মুক্তি চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার জন্য হামাসের ওপর প্রবল চাপ তৈরি করা। আর হামাস যত বেশি অস্বীকৃতি জানাবে, আইডিএফের অভিযান ততই জোরদার হবে।'
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন সপ্তাহে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে সরে যেতে বলা হয়েছে। পুরো সংঘাত জুড়েই বহু মানুষ আশ্রয়ের জন্য হাসপাতালগুলোর ওপর নির্ভর করেছেন।
আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালের এক রোগী মোহাম্মদ আবু নাসের সিএনএনকে জানিয়েছেন, হামলার সময় তিনি হাসপাতালের ভেতরেই ছিলেন। তিনি বলেন, 'আমরা ভেবেছিলাম, হাসপাতালের ভেতরেই সবাই মারা যাব... এখন আমার কোনো চিকিৎসা নেই, কিছুই নেই। চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই।'
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হাসপাতালটি সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে এবং মানুষকে তিনটি অন্য হাসপাতালে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জেরুজালেমের ধর্মীয় অঞ্চল থেকে হামলার নিন্দা জানিয়ে বলা হয়েছে, জরুরি বিভাগের ক্ষতির পাশাপাশি দুইতলা জেনেটিক ল্যাবরেটরি ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা আরও বলেছে, এটি ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে হাসপাতালটিতে পঞ্চম হামলা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, বর্তমানে 'অকার্যকর' হয়ে পড়া হাসপাতালের ফার্মেসিও ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ৫০ জন রোগীকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে, ৪০ জন সংকটাপন্ন রোগীকে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি।
গাজা জুড়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ওষুধ ও সরঞ্জামের অভাবে চাপের মধ্যে থাকায় ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, আল-আহলি এবং ইন্দোনেশীয় হাসপাতালে তাদের দুটি মিশন ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, গাজার হাসপাতালগুলো 'নজরবন্দি পরিস্থিতিতে রয়েছে। অথচ মানবিক সহায়তা সরবরাহ কমে আসছে, যা ডব্লিউএইচও-কে হাসপাতালগুলোকে নতুন করে সরবরাহ করতে এবং রোগীদের জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা সুরক্ষিতভাবে প্রদান করতে বাধা দিচ্ছে।'
আল-আহলি হাসপাতালে কাজ করা ডাক্তার সামের আত্তার সিএনএনকে বলেছেন, এই হামলা একটি 'হতাশাজনক পরিস্থিতি' তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, 'এখানে মানুষেরা ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত। তারা শুধু শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও আহত।'
আল-আহলি গাজার একমাত্র সচল হাসপাতালগুলোর মধ্যে একটি। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার রোগীকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। গত বছর ইসরায়েলি অবরোধের ফলে গাজার বৃহত্তম হাসপাতাল আল-শিফা ধ্বংস হয়ে যায়। কয়েক মাস পর সেখানে কিছুকে রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু হয়।
যুক্তরাজ্য, কাতার এবং সৌদি আরবসহ আন্তর্জাতিক মহল থেকে এ হামলার প্রতি নিন্দা জানানো হয়েছে।
মধ্য গাজায় প্রাণঘাতী হামলা
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা গাজার বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। রোববার তারা জানায়, গাজার উত্তরে একটি অস্ত্র গুদামে হামলা চালানো হয়েছে এবং গত ৪৮ ঘণ্টায় বিমান বাহিনী গাজা জুড়ে 'সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ৯০টিরও বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা' করেছে।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায় একটি ভবনে বিমান হামলা হয়েছে। আইডিএফ বলেছে, ভবনটি হামাসের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ছিল এবং সেখানে 'অনেক সন্ত্রাসী' ছিল। পরে জানানো হয়, তারা হামাসের স্নাইপার দলের উপপ্রধান উবাইদ আল্লাহ নাঈম আল-হাধুদ মুসাকে হত্যা করেছে।
আল-আকসা শহীদ হাসপাতালের মুখপাত্র জানান, ওই হামলায় তিনজন নিহত হন এবং কাছাকাছি আরেকটি হামলায় ছয় ভাইসহ সাতজন নিহত হন। একইদিনে দেইর আল-বালাহর পৌর ভবনে হামলায় হামাস-নিয়ন্ত্রিত বিচার মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গাজা থেকে ছোড়া একটি রকেট ভূপাতিত করার পর দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে কিছু এলাকাকে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ তারা জানিয়েছে, 'যেখান থেকে রকেট ছোড়া হবে, সেখানে প্রবল শক্তিতে হামলা চালানো হবে।'
তারা জানায়, হামাসকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করতে অভিযান আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে।
জিম্মিদের একজন, আমেরিকান-ইসরায়েলি এদান আলেকজান্ডার শনিবার হামাস প্রকাশিত একটি ভিডিওতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি তাকে উদ্ধারের আহ্বান জানান। ভিডিওতে তিনি বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি ট্রাম্প আমাকে গাজা থেকে মুক্ত করতে পারবেন।' ভিডিওটি কবে ধারণ করা হয়েছে তা জানা না গেলেও তিনি বলেন, 'আমি ৫৫১ দিন ধরে গাজায় আছি।'
ইহুদি ধর্মীয় উৎসব 'পাসওভারের' আগের দিন এই ভিডিও প্রকাশ পায়। 'হোস্টেজ অ্যান্ড মিসিং ফ্যামিলিজ ফোরাম' উৎসবের টেবিলে জিম্মিদের জন্য একটি খালি স্থান রাখার আহ্বান জানায়।
এদিন আলেকজান্ডারের বাবা-মা ইয়ায়েল ও আদি বলেন, 'প্রতিটি মুহূর্ত আরও অসহ্য হয়ে উঠছে। ওর মুখেই তা দেখা যায়—ভয়, হতাশা।' তারা বলেন, 'প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, এখন আমাদের আশা আর বিশ্বাস আপনার ওপর।'