বইয়ের ব্যবসায় ফিরে যেভাবে বাজিমাত করল বার্নস অ্যান্ড নোবল
আপার ম্যানহ্যাটনকে দুভাগে ভাগ করেছে সেন্ট্রাল পার্ক—তার সঙ্গে যেন ভাগ হয়ে গেছে পাঠাভ্যাসও। আপার ওয়েস্ট সাইডে বার্নস অ্যান্ড নোবলের স্থানীয় শাখার সহকারী ব্যবস্থাপক ভিক্টোরিয়া হার্টি জানান, বই বিক্রির ক্ষেত্রে নিউইয়র্ক টাইমস--এর প্রভাব 'আমাদের জন্য বেশ ভালো'। অন্যদিকে, ইস্ট সাইডের পাঠকেরা বেশি ভরসা রাখেন ওয়াশিংটন পোস্ট ও দি আটলান্টিক-এর পরামর্শে।
পুব ও পশ্চিম—দুই এলাকার মানুষের জন্য আলাদা করে সাজানো টেবিলজুড়ে থাকে পরামর্শভিত্তিক বইয়ের প্রদর্শনী। এভাবে বই সাজিয়ে রাখাটা স্বাধীন বইয়ের দোকানে স্বাভাবিক হলেও প্রায় এক দশক ধরে বার্নস অ্যান্ড নোবল-এ এরকম ব্যবস্থা ছিল না। কারণ, তারা নিজেদের গড়ে তুলেছিল জেনেরিক রিটেইলারের আদলে। আর তাতে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার জোগাড় হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির।
তবে এখন অবস্থা বদলাচ্ছে। ২০২৪ সালে বার্নস অ্যান্ড নোবল ৫৭টি নতুন শাখা চালু বা পুনরায় চালু করেছে। তাদের মোট দোকানের সংখ্যা এখন প্রায় ৬৫০। চলতি বছর আরও ৬০টি দোকান খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।

২০১৯ সালে বার্নস অ্যান্ড নোবলের প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব নেওয়া জেমস ডন্ট বলেন, 'একসময় কী ভয়াবহ অবস্থায় ছিলাম, তা মনে করলেই দমবন্ধ হয়ে আসে।' ওই বছরের গ্রীষ্মেই ৬৮৩ মিলিয়ন ডলারে বার্নস অ্যান্ড নোবল কিনে নেয় এলিয়ট ম্যানেজমেন্ট। তার আগের বছর তারা কিনেছিল ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় বই বিক্রির প্রতিষ্ঠান ওয়াটারস্টোনসকে। ওয়াটারস্টোনসকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন জেমস ডন্ট। এবার তাকে আমেরিকান বাজারেও একই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এখন তিনি বলছেন, 'আমরা ভালোই আয় করছি।' (যেহেতু বার্নস অ্যান্ড নোবল এখন বেসরকারি ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, তাই তারা আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করে না।)
বার্নস অ্যান্ড নোবলের সংকট শুরু হয় ২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার পর, যা ভোক্তাদের খরচ কমিয়ে দিয়েছিল। এরপর অ্যামাজনের উত্থান পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে। তখন বার্নস অ্যান্ড নোবল ভাবল, বইয়ের ভবিষ্যৎ সিডির মতোই—অপাঙক্তেয় হয়ে পড়বে। তাই তারা তৈরি করল অ্যামাজনের কিন্ডলের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়ে এল নুক। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তি করল, ইনভেন্টরি খালি করে ফেলল, আর কর্মী নিয়োগ করল হার্ডওয়্যার বিক্রির জন্য।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সিইও স্টিফেন রিগজিও বলেছিলেন, 'আশা করছি, ২০১০ হবে বার্নস অ্যান্ড নোবলের প্রথাগত ফিজিক্যাল দোকান থেকে বৃহৎ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের বছর।'
কিন্তু সেই ধারণা বাস্তব রূপ পেল না। বার্নস অ্যান্ড নোবলের স্টোর স্ট্র্যাটেজির নেতৃত্ব দেওয়া জ্যানিন ফ্ল্যানিগান বলেন, 'অ্যাপল হওয়ার চেষ্টা…আমাদের পক্ষে কাজ করেনি।'
এরপর বার্নস অ্যান্ড নোবল বিনিয়োগ শুরু করল গেমস, উপহার আর খেলনায়। সহকারী ব্যবস্থাপক হার্টি বলেন, এই বইয়ের দোকান একসময় হয়ে উঠছিল অফিস-উপকরণ বিক্রির দোকান। তার তখন জ্যান্সপোর্ট বিক্রি করতেন।
ডন্ট ভাবলেন, এসব পণ্য বই বিক্রির ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তাই ভালো বিক্রি হওয়ার পরও বোতলজাত পানি বাদ দেন তিনি।
দোকানগুলোর রূপ বদলে দিলেন ডন্ট। প্রকাশকদের করা পেইড প্রমোশন বন্ধ করে দিলেন। বইয়ের তাকগুলো সাজালেন নতুন করে, যাতে স্বচ্ছন্দে ঘুরে ঘুরে বই দেখা যায়। আগে 'ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি' বিভাগে বই সাজানো হতো লেখকের নামের বর্ণানুক্রমে, এখন আর সেভাবে সাজানো হয় না। ডন্ট বলেন, ক্রেতা যদি জানেনই যে তিনি ফরাসি বিপ্লবের ওপর লেখা সাইমন শামা-র 'সিটিজেনস' বইটা খুঁজছেন, তাহলে তিনি সরাসরি অ্যামাজনে গিয়েই কিনতে পারেন।
বার্নস অ্যান্ড নোবলের প্রধানের মতে, সব বইয়ের দোকান মোটামুটি একই দলে, আর অ্যামাজন হচ্ছে বিপরীত পক্ষ।

ডন্ট ১৯৯০ সালে লন্ডনে ডন্ট বুকস নামে একটি ছোট বুকশপ চেইন চালু করেন। এখনও সেই বুকশপের নয়টি শাখার দেখভাল করেন নিজেই।
ডন্ট বলেন, এই শিল্প কোনো 'জিরো-সাম' গেম নয়—বড় বইয়ের বুকশপ চেইনগুলো পাঠকদের মুদ্রিত বই কেনার অভ্যাস ধরে রাখতে সাহায্য করে, আর তাতে লাভ হয় সব পক্ষের।
তার ভাষ্য, তিনি সচেতনভাবে স্বাধীন বইয়ের দোকানের আশেপাশে নতুন শাখা খোলেন না। তবে সবাই ডন্টের সঙ্গে একমত নন। আমেরিকান বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের অ্যালিসন হিল বলেন, বার্নস অ্যান্ড নোবলের সম্প্রসারণ অনেক স্বাধীন দোকানের ক্ষতি করছে।
তবে যা পুরো বই শিল্পকে তর্কাতীতভাবে উপকৃত করেছে, তা হলো বুকটক। টিকটকের এই সাবকমিউনিটির উত্থান ২০২০ সালে। ইনফ্লুয়েন্সারর ওই বছর থেকে নতুন পড়া বইয়ের কথা জানাতে শুরু করেন, দিতে থাকেন কোন বই পড়া যায় সে পরামর্শও।
বুকটক হ্যাশট্যাগে এখন ৪০ মিলিয়নের বেশি পোস্ট রয়েছে। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর এ প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে ডিজিটাল দুনিয়ার বাইরেও।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্কানা জানায়, ২০২১ সাল—যে বছর বুকটক জনপ্রিয়তা পায়—ছিল ২০০৪ সালের পর মুদ্রিত বইয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো বছর। বুকটকের জনপ্রিয় ঘরানাগুলোর—ফ্যান্টাসি, রোমান্স, থ্রিলার—বিক্রি বাড়ছে তুমুল গতিতে।

বুকটককেও নিজেদের ফিরে আসার কিছুটা কৃতিত্ব দেন ডন্ট। বার্নস অ্যান্ড নোবলের বই বিভাগের প্রধান শ্যানন ডিভিটো সিএনএনকে বলেন, বইপ্রেমে নতুন করে জোয়ার নিয়ে আসার পাশাপাশি বুকটক ট্রেন্ড বইয়ের দোকানগুলোকেও পথ দেখিয়েছে কোন কোন বই স্টকে রাখতে হবে।
এছাড়া বুকটক ট্রেন্ড বইয়ের দোকানে পাঠক-ক্রেতাদের যাতায়াতও বাড়িয়েছে। বুকটক কনটেন্ট ক্রিয়েটর কেন্ড্রা কিটার-গ্রে সিএনএনকে বলেন, বন্ধুদের সঙ্গে মিলে তিনি ৩০ মিনিট পথ হেঁটেই যেকোনো বার্নস অ্যান্ড নোবলের সাখায় গিয়ে কয়েক ঘণ্টা সময় কাটাতে পারেন। তারা সাধারণত দোকানের বুকটক অংশে সময় কাটান।
'বার্নসের যাওয়ার ব্যাপারটা অনেকটা আনন্দভ্রমণের মতো। ছোটবেলায় বাবা-মা আমাকে সিক্স ফ্ল্যাগসে [অ্যামিজমেন্ট পার্ক] নিয়ে যেতেন, ব্যাপারটা তার মতোই,' বলেন তিনি।

এই বুকটক-জাদুর কিছুটা ধরতে চায় বার্নস অ্যান্ড নোবল। তাদের দোকানে নতুন বইয়ের 'এক্সক্লুসিভ সংস্করণ' থাকে, যেগুলো বুকটকাররা 'ট্রফি'র মতো নিজেদের সংগ্রহে রাখে। প্রতিষ্ঠানটির ম্যানহ্যাটন ইউনিয়ন স্কয়ার শাখা বুকটকের জনপ্রিয় বইয়ের জন্য মধ্যরাতের বই-উন্মোচন উৎসব আয়োজন করে। আয়োজনটি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
এছাড়া কস্টিউম প্রতিযোগিতার আয়োজনও করে বার্নস অ্যান্ড নোবল। ডিভিটো জানান, এসব আয়োজন বই প্রকাশ নিয়ে উত্তেজনা তৈরি করেছে। হ্যারি পটারের পর আর কোনো বইয়ের প্রকাশনা নিয়ে এমন উত্তেজনা দেখা যায়নি।