প্রকৃতির জন্য উৎসর্গ করেছেন জীবন, মাহমুদুল পেলেন জাতীয় পরিবেশ পদক

শৈশবে মাহমুদুলের সবচেয়ে প্রিয় খেলা ছিল বাড়ির আঙিনায় গাছ লাগানো। পাশাপাশি পাখিদের খাবার খাইয়ে বড় সুখ পেতেন তিনি। স্কুলে বন্ধুরা যখন এটা-ওটা কিনে খেত, মাহমুদুল তখন টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনতেন গাছের চারা। নিজের জন্য নয়, চারাগুলো রোপণ করতেন এলাকাজুড়ে।
মাহমুদুলের শুরুটা হয়েছিল এভাবেই। তখন অনেকে তাকে বলতো 'পাগল'! আশার কথা, এ 'পাগলামিগুলো' কখনোই থেমে যায়নি তার। বরং পৌঁছে গেছে এলাকার সর্বত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ আর বিনামূল্যে বই পড়ানোর কার্যক্রম।

গাছ আর শিশুদের বিকাশে আশৈশব কাজ করা মাহমুদুল পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। প্রকৃতি ও পরিবেশের সংরক্ষণে অবদানের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে তাকে 'জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪' প্রদান করেছে সরকার।
গল্পটি একটি সাইকেলেরও
ভাঙাচোরা এক সাইকেলে মাঝে-মধ্যেই পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় এক যুবককে। সাইকেলের ক্যারিয়ারে থাকে গাছের চারা আর গল্পের বই। হঠাৎ কোথাও থেমে সেসব চারা উপহার দেন তিনি, আবার গ্রামে গ্রামে ধার দিয়ে বেড়ান বই। মাঝে মাঝে গ্রামের শিশুদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসান গল্পপাঠের আসর। শুধু কি তাই? সাইকেলে ঘুরতে ঘুরতে কোথাও ময়লা-আবর্জনা দেখলে নিজ হাতে পরিষ্কার করেন সেগুলো।

এই যুবকের পুরো নাম মাহমুদুল ইসলাম মামুন। তেঁতুলিয়ার আজিজনগর গ্রামে জন্ম। বাবা সরকারি চাকরি করতেন। বেশকিছু কৃষি জমি ছিল তাদের। শৈশবে বাবা-মাকে দেখেছেন কঠোর পরিশ্রম করতে। বাড়িতে কৃষিকাজ দেখে দেখে মনটা কবে যে পুরোপুরি মিশে গেছে প্রকৃতির সঙ্গে, বুঝতে পারেননি তিনি।
২০১৩ সালে কলেজে ভর্তি হন মাহমুদুল। ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন গাছের চারা নিয়ে। পরে সাইকেলে করে বিলি করতেন এলাকায়।
মাহমুদুল জানালেন, সারাজীবন সচেতনভাবেই জাঁকজমক বিষয়টি এড়িয়ে চলেছেন তিনি। তাই সাইকেলই বেছে নিয়েছিলেন বাহন হিসেবে। এখনও তার কাজকর্মের প্রধান সঙ্গী ওই সাইকেল।

বাড়ির কাজ সেরে মাহমুদুল সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়েন গ্রামে। সাইকেলে থাকে বই আর গাছ। গ্রামে ঘুরে ঘুরে বই দিয়ে আসেন। পাঠ শেষে আবার ফেরত নিয়ে দেন নতুন বই। কৃষিকাজও করেন তিনি। চায়ের বাগান, পুকুরে মাছচাষ দেখাশোনা, বাড়িতে পশু-পাখি লালন-পালন শেষ করে বিকেলে আবার বেরিয়ে পড়েন। এভাবে কেটে যায় দিন। এর মাঝে বেশ কিছুটা সময় কাটে গ্রামের কচিকাঁচাদের সঙ্গে।
'আকাশতলার পাঠশালায়' বসে গল্পের আসর
ছাত্রজীবনে 'পথের পাঁচালী' পড়ে মাহমুদুল ঠিক করেছিলেন, সাহিত্য নিয়েই পড়তে হবে তাকে। রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে। এরপর গ্রামে ফিরে অন্যদের বই পড়ানোটাকেও দায়িত্ব হিসেবে তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে।

গ্রামে ঘুরে ঘুরে মাহমুদুল শিশুদের নিয়ে গল্প পাঠের আসর বসান। নিজে গল্প পড়ে শোনান তাদের। আবার বই পড়তেও দিয়ে আসেন। খোলা আকাশের নিচে এ আসরের নাম দিয়েছেন 'আকাশতলার পাঠশালা'!
মাহমুদুল জানালেন, শিশুদের জীবনাচারও শেখান তিনি। 'ওদের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করি আমি। ওরা ভালো আচরণ শিখছে। এলাকায় কেউ আর পাখি শিকার করে না। আর বই পড়াতে ওদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। এক সপ্তাহে বই শেষ করে, তারপর বলে আরও বই দাও', বললেন তিনি।
মাহমুদুলের বাড়িতে আছে 'প্রকৃতির পাঠাগার'। বাঁশ-ছন দিয়ে নির্মিত গোলাকৃতির এ পাঠাগারের জন্য নিজের টাকায় বই কেনেন তিনি। প্রতিদিন সকালে পাঠাগার খুলে দেন। যে কেউ চাইলেই এসে পড়তে পারে এখানে।

বই, বৃক্ষ আর শিশুদের নিয়ে জীবন
মাহমুদুল এখন নিজেই গাছের চারা তৈরি করেন। বিকেলটা রাখেন এ কাজের জন্য। সকাল থেকে সন্ধ্যা - প্রকৃতি আর শিশুদের সঙ্গেই কাটে তার।
বিয়ে করেননি মাহমুদুল। করার কথা আপাতত ভাবছেনও না। জানালেন, সংসার করলে বাইরের কাজগুলো করা কঠিন হয়ে যাবে তার জন্য। তাই এখনও এ নিয়ে ভাবছেন না।
মাহমুদুল আগে যেসব চারা রোপণ করেছিলেন, সেগুলো এখন বড় হয়েছে। তাতে ফল-ফুল হচ্ছে, ছায়া দিচ্ছে গাছ। পাখিরা এসে বসছে সেসব গাছে। এগুলো দেখে বড় আনন্দ পান তিনি। এ নিয়েই বাকিটা জীবন কাটাতে চান।

একসময় অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছেন মাহমুদুল। পুরস্কার পাওয়ায় এবার সেসবের জবাব দিতে পারবেন বলে জানালেন তিনি। বললেন, 'অনেকেই জিজ্ঞেস করত, এসব করে কী পাও? তাদের উত্তর দিতে পারতাম না। আসলেই তো বস্তুগত কিছু পাই না। তবে এ পুরস্কারটা এবার একটা উত্তর হবে। তারা জানবেন, রাষ্ট্র আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।'
পুরস্কার উৎসর্গ করেছেন মাকে
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে জাতীয় পরিবেশ পদক পেলেন মাহমুদুল। পদকটি তিনি উৎসর্গ করেছেন মাকে, যিনি তার সারাজীবনের অনুপ্রেরণা।
মাহমুদুলের মতে, পরিবেশ নিয়ে কাজ করলে আপসহীন থাকতে হয়। তা-ই তিনি থেকেছেন বছরের পর বছর। সামনেও থাকতে চান।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে জানতে চাইলে বললেন, 'আমি সবসময় সৃষ্টিকর্তাকে বলি, আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিন। কেউ কাজ করতে চায় না, পরিবেশের, জীবনের ক্ষতি করে বেড়ায়। আমি চাই তিনি যেন আমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেন।'
পৃথিবীতে যতদিন বেঁচে আছেন, এভাবেই কাজ করে যেতে চান তিনি। শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার যেমন নির্দিষ্ট সময়-কাল নেই, পরিবেশের সেবা করারও সময়-কাল নেই। এটা সবসময় করে যেতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
সবশেষে মাহমুদুল বললেন, এই রাষ্ট্রীয় পদক প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি তার দায়বদ্ধতা আরও বাড়িয়ে দিল।
ছবি: সৌজন্যেপ্রাপ্ত