হিন্দু রাষ্ট্র ভুয়া, কিন্তু ভারতীয় পলাতক সাধুর বলিভিয়ায় জমি দখল মিথ্যে না

নিজস্ব পাসপোর্ট, সংবিধান, এমনকি সোনা দিয়ে তৈরি মুদ্রাও আছে তাদের। রয়েছে 'মহাজাগতিক সংবিধান', রিজার্ভ ব্যাংক। এমনকি জাতিসংঘে 'প্রতিনিধি' পাঠানোর দাবিও করেন তারা। তাদের মতে, এটি 'বিশ্বের প্রথম সার্বভৌম হিন্দু রাষ্ট্র'।
এই কল্পিত রাষ্ট্র 'ইউনাইটেড স্টেটস অব কৈলাসা'র নেতা হলেন ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে পলাতক ভারতীয় সাধু স্বামী নিত্যানন্দ। তার দাবি, তিনি পুনর্জন্ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং ধনীদের এমন ভবিষ্যৎ দিতে পারেন, যাতে পরজন্মেও ধনী হয়ে জন্মান, এমনকি গরিব হয়ে জন্মালেও!
এই ভুয়া রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বিশ্বনেতাদের সঙ্গে ছবি তুলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এমনকি জাতিসংঘে বক্তব্যও দিয়েছেন বলে দাবি করা হচ্ছে।
নানা কল্পনার মধ্যে নিমজ্জিত থাকলেও সম্প্রতি বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাদের।
বলিভিয়ার সরকার জানিয়েছে, 'কৈলাসা' নামের এই কল্পিত রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযোগ, তারা স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে ভুয়া চুক্তির মাধ্যমে আমাজনের বিস্তীর্ণ জমি এক হাজার বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে।
সরকার এসব চুক্তি বাতিল করে অভিযুক্তদের দেশ থেকে বহিষ্কার করেছে। তবে তাদের কেউই কৈলাসার নাগরিক নন, বরং তাঁরা ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন ও চীনের নাগরিক। বলিভিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, 'ইউনাইটেড স্টেটস অব কৈলাসা'-এর সঙ্গে বলিভিয়ার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
নিউইয়র্ক টাইমস এ বিষয়ে কৈলাসার তথাকথিত 'প্রেস অফিস অব দ্য হলি সি অব হিন্দুইজম'-এর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
এই অদ্ভুত কাহিনির শুরু ২০১৯ সালে। ঐ বছর ধর্ষণ, নির্যাতন ও শিশু নিপীড়নের অভিযোগে স্বামী নিত্যানন্দ ভারত থেকে পালিয়ে যান।
নিত্যানন্দের আসল নাম অরুণাচলম রাজশেখরন। তিনি ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন এবং কুড়ি বছর বয়সে বেঙ্গালুরুর কাছে প্রথম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন।
নিত্যানন্দ সময় সময় নানা উদ্ভট দাবি করতেন। যেমন, অন্ধদের 'তৃতীয় চোখ' দিয়ে দেখাতে পারা কিংবা সূর্যোদয় ৪০ মিনিট পিছিয়ে দেওয়া। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠার পর তিনি দাবি করেন, এটি হিন্দুবিরোধীদের ষড়যন্ত্র এবং তাঁর জমি দখলের চেষ্টা।
পালিয়ে যাওয়ার পর তিনি দক্ষিণ আমেরিকা বা ক্যারিবীয় অঞ্চলে আশ্রয় নেন বলে ধারণা করা হয়। পরে তিনি 'ইউনাইটেড স্টেটস অব কৈলাসা' নামে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তার মতে এর মাধ্যমে অতীত হিন্দু রাজ্যের পুনর্জন্ম হবে।
একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে 'কৈলাসা'র ডিজিটাল নাগরিকত্বও বিতরণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির নিউয়ার্ক শহরের মেয়র 'সিস্টার সিটি' চুক্তি করে পরে তা বাতিল করেন। প্যারাগুয়ের এক কর্মকর্তা কৈলাসার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে পদত্যাগ করেন।
সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারিটি প্রকাশ্যে আসে বলিভিয়ার একটি পত্রিকার অনুসন্ধানে। জানা যায়, কৈলাসার প্রতিনিধিরা বাউয়া নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জমি ইজারার চুক্তি করেছে।
গোষ্ঠীর নেতা পেদ্রো গুয়াসিকো জানান, তারা প্রথমে বনে দাবানলে বিপর্যস্ত এলাকায় সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে আসে। এরপর নয়াদিল্লির তিন গুণ আয়তনের জমি বছরে প্রায় দুই লাখ ডলারের বিনিময়ে ২৫ বছরের জন্য ইজারা নেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
তবে এখানেও প্রতারণার আশ্রয় নেয় কৈলাসার প্রতিনিধিরা। দেখা যায়, ইংরেজিতে লেখা চুক্তিতে এক হাজার বছরের ইজারা, আকাশসীমা ব্যবহার ও প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের শর্ত ছিল। গোষ্ঠীর নেতা বলেন, তারা না বুঝেই সই করেছেন, যা ছিল সম্পূর্ণ প্রতারণা।
পেদ্রো গুয়াসিকো বলেন, 'তাঁদের কথায় ভুল করেছি। আমাদের অঞ্চল সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য বার্ষিক বোনাস দেওয়ার প্রস্তাব ছিল, কিন্তু সবই ছিল মিথ্যা।'