অ্যাপলও কি ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের দুঃস্বপ্নে আটকা পড়ল!

অ্যাপল এক সময় আমেরিকা ও চীনের জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে অনেকে আশা করেছিলেন, এই কোম্পানির প্রভাব হয়তো দুই পরাশক্তির মধ্যে সংঘাত ঠেকাতে পারে। কিন্তু এখন সেই আইফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিকার হতে চলেছে—যে কোনো বড় আমেরিকান কোম্পানির চেয়েও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বাড়ার কারণে কোম্পানিটির উৎপাদন খরচ বাড়বে, যা তাদের সবচেয়ে বড় বাজার। আর চীনের পাল্টা প্রতিক্রিয়া অ্যাপলের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারে বিক্রিও কমিয়ে দিতে পারে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী টিম কুক আগে কখনও এমন জটিল ভূরাজনৈতিক চাপে পড়েননি, যেখানে তাকে নিজের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের বৈধতা প্রমাণ করতে হচ্ছে।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের হুমকিতে ৩ এপ্রিল অ্যাপলের বাজারমূল্য থেকে এক ধাক্কায় ৩১১ বিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে যায়। তার আগের দিনই ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, আমেরিকার প্রায় সব বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর 'পারস্পরিক' শুল্ক বসানো হবে। এরপর ৪ এপ্রিল চীনও পাল্টা জবাব দেয়—সব আমেরিকান পণ্যে ৩৪ শতাংশ শুল্ক এবং বিরল খনিজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে অ্যাপলের শেয়ারের দর আরও পড়ে যায়। এই ধাক্কা অন্য কোনো প্রযুক্তি জায়ান্টের জন্য এত বড় ছিল না, কারণ অন্য কেউ-ই হার্ডওয়্যার ব্যবসার ওপর অ্যাপলের মতো এতটা নির্ভরশীল নয়।
এই আকস্মিক দরপতন টিম কুকের জন্য নিঃসন্দেহে হতবাক হওয়ার মতো ছিল। মাত্র ছয় সপ্তাহ আগে তিনি নতুন প্রেসিডেন্টকে খুশি করতে চোখে পড়ার মতো এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন—ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার কোম্পানি আগামী চার বছরে আমেরিকায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে।
এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবসম্মত ছিল কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে; অনেকের মতে এটি ট্রাম্পকে ইঙ্গিত দেয়া যে, তিনি যেন অ্যাপলকে তার শুল্ক হামলার থেকে কিছুটা ছাড় দেন—যেমনটি তিনি তার প্রথম মেয়াদে করেছিলেন। তবে এখন পর্যন্ত তা কাজ করেনি।
যখন শুল্ক ঘোষণা করা হয়, তখন তা অ্যাপলের জন্য আরও খারাপ ছিল, যা তারা কল্পনাও করেনি। হোয়াইট হাউসে ফিরে আসার পর, ট্রাম্প চীনের ওপর আরও ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন—যেখানে অ্যাপল তাদের প্রতি ১০টি আইফোনের মধ্যে ৯টি তৈরি করে। নতুন করে শুল্ক আরোপের পর মোট শুল্ক দাঁড়িয়েছে ৫৪ শতাংশে— এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ এশীয় দেশগুলোতেও আঘাত হেনেছে, যেখানে অ্যাপল ধীরে ধীরে তার উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। যেমন, আইফোন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হওয়া ভারতে ২৬ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এছাড়াও, ভিয়েতনাম, যেখানে অ্যাপল ওয়্যারেবল ডিভাইস যেমন অ্যাপল ওয়াচ এবং এয়ারপড তৈরি করে, সেখানেও আরোপ করা হয়েছে ৪৬ শতাংশ শুল্ক।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে শুরু হওয়া বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে, অ্যাপল এই দেশগুলোতে তার উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল, যাতে চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়। কিন্তু এই প্ল্যান 'বি'ও এখন কাজ করছে না। এখন টিম কুকের জন্য জরুরি হয়ে উঠেছে একটি 'প্ল্যান সি'।
যদি ট্রাম্প অ্যাপলকে শেষ মুহূর্তে কোনো ছাড় না দেন, তবে নতুন শুল্ক আরোপের তাৎক্ষণিক ফল হবে বাড়তি ব্যয়। ইউবিএস ব্যাংকের ডেভিড ভগট ধারণা করেন, সাত কোটির বেশি আইফোনের এক তৃতীয়াংশ চীনে অ্যাসেম্বল করা হয় এবং তারপর আমেরিকায় বিক্রি করা হয়।
ডেভিটের ধারণা ট্রাম্প যে শুল্ক আরোপ করেছেন—যা মোটামুটিভাবে ৬০%, তা খুচরা মূল্যের পরিবর্তে উৎপাদন ব্যয়ের ওপর প্রযোজ্য হবে। এর মানে হলো, তারা একটি আইফোনের ৫৫০ ডলার কাঁচামালের ব্যয়ের সাথে ৩৩০ ডলার যোগ করতে হতে পারে (যদি থাইওয়ানে তৈরি সেমিকন্ডাক্টরগুলো চীনে তাদের সংযোজনের কারণে শুল্কের আওতায় আসে)। আর এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে—এই অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে?
এই খরচ গ্রাহকদের ওপর চাপানো হতে পারে, তবে এটি সহজ নয়। গত বছরে অ্যাপলের আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছিল আইফোনের বিক্রি থেকে, কিন্তু এখন বিক্রি কমেছে।
সবচেয়ে উন্নত আইফোনগুলোর খুচরা দাম শুরু হয় ৯৯৯ ডলার থেকে, এমন পরিস্থিতিতে অ্যাপলকে আরও দাম বাড়ানো কঠিন, কারণ এতে গ্রাহকরা আরও বেশি নিরুৎসাহিত হতে পারেন। এছাড়া, অ্যাপল ইন্টেলিজেন্স নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বৈশিষ্ট্যও প্রত্যাশিত সাড়া জাগাতে পারেনি।
অথবা, অ্যাপল চাইলে বিনিয়োগকারী ও সরবরাহকারীদের ওপর চাপ বাড়াতে পারে। ইউবিএস-এর ডেভিড ভগটের অনুমান, শুল্কের কারণে অ্যাপলের মোট লাভের হার ৪৬ শতাংশ থেকে কমে ৪০ শতাংশে নেমে যেতে পারে এবং এই বছরের শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) কমে যেতে পারে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত। এই আশঙ্কাই আংশিকভাবে অ্যাপলের শেয়ারদামে হঠাৎ বড় পতনের কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
কাউন্টারপয়েন্ট রিসার্চের গ্যারিট শ্নীমান মনে করেন, অ্যাপলের লাভের হার বেশি হওয়ায়, প্রতিদ্বন্দ্বী যেমন স্যামসাং—যা এশিয়াতেই ফোন তৈরি করে—তাদের তুলনায় অ্যাপল এই ধাক্কা কিছুটা ভালোভাবে সামলাতে পারবে। তার মতে, অ্যাপল চাইলে এর বিশ্বস্ত সরবরাহকারীদেরও কিছু বোঝা বহনের জন্য রাজি করাতে পারে। তবে, সব কিছু মিলিয়ে শুল্কের প্রভাব বড় ধাক্কাই হবে।
আমেরিকায় ব্যয় বাড়া একটি দিক। অন্যদিকে আছে চীন। সম্ভাবনা রয়েছে, চীনের পাল্টা শুল্কের কারণে কিছু যন্ত্রাংশ চীনে আমদানি করা আরও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে—যেমন, অ্যাপলের আইফোনে ব্যবহৃত 'গরিলা গ্লাস' তৈরি করে আমেরিকার কেনটাকি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান কর্নিং। শ্নীমান আশঙ্কা করছেন, চীনের বিরল খনিজ রপ্তানিতে বিধিনিষেধ অ্যাপলের সরবরাহকারীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
এরপর আছে চীনে বিক্রির ঝুঁকি। গ্যারিট জানান, গত বছর চীনে অ্যাপলের আয় ৮ শতাংশ কমে গিয়েছিল, যার বড় কারণ ছিল আইফোন ও আইপ্যাডের চাহিদা হ্রাস। এখন আশঙ্কা রয়েছে, ট্রাম্পের কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ চীনা ভোক্তারা অ্যাপলকে 'বলির পাঁঠা' বানিয়ে সেই পতনের গতি আরও বাড়াতে পারেন যেখানে দেশজ উৎপাদক হুয়াওয়ে, অপ্পো এবং শাওমির জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।
এছাড়া, চীনা সরকার চাইলে অ্যাপলের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে—যদিও অ্যাপল এবং এর সরবরাহকারীদের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান থেকে দেশটি বিপুলভাবে লাভবান।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্লুমবার্গ-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাপল অ্যাপ ডেভেলপারদের কাছ থেকে কী ফি নেয় তা নিয়ে সম্ভাব্য তদন্তের কথা বিবেচনা করছে তাদের অ্যান্টিট্রাস্ট নজরদারি প্রতিষ্ঠান, যা যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে উত্তেজনার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
যদি চীন আর আতিথ্য না দেয়, এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশও আর নিরাপদ বিকল্প না থাকে, তাহলে অ্যাপল পরবর্তী গন্তব্য কোথায়? ট্রাম্প শিবিরের মতে, উত্তরটি হচ্ছে—আমেরিকা।
দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী হাওয়ার্ড লাটনিকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, অ্যাপলের ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্রেই উৎপাদন সরিয়ে আনার সূচনা। তবে 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' স্লোগানধারীরা কাজটি যতটা সহজ মনে করছেন, বাস্তবে তা ততটাই কঠিন।
শুরুতেই অ্যাপলের প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ নিয়ে বলা যাক। ইউবিএস-এর ডেভিড ভগট এই প্রতিশ্রুতিকে 'পাবলিক রিলেশনের ফুলঝুরি' বলে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, চার বছরে ৫০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ মানে অ্যাপলকে তার বাৎসরিক ফ্রি ক্যাশফ্লো—যা প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলার—পুরোটাই খরচ করতে হবে। এর আগে ট্রাম্পের প্রথম দফা শাসনে অ্যাপল পাঁচ বছরে ৩৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল, আর সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলেও আরেকটি বড় প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবে সেসব প্রতিশ্রুতি বড় কোনো নির্মাণকাজে রূপ নেয়নি।
এছাড়া, অ্যাপলের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ম্যাক ছাড়া অন্য কিছু উৎপাদন আমেরিকায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত বাধাও অনেক বেশি। অ্যাপলের জন্য সেমিকন্ডাক্টর তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান টিএসএমসি-কে অ্যারিজোনায় উৎপাদন শুরু করতে কয়েক বছর সময় এবং বিশাল ভর্তুকি দিতে হয়েছে। তেমনভাবেই আইফোনের পাওয়ার সিস্টেম, কেসিংসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহকারী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমেরিকায় আনতেও বহু সময় লাগবে। কিন্তু এখনো ট্রাম্প প্রশাসন এমন কোনো প্রণোদনা দেয়নি, যা এসব সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে আকৃষ্ট করতে পারে।
জিরোওয়ানহান্ড্রেড নামের এক সাপ্লাই-চেইন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কেভিন ও'মারা বলেন, টিম কুক চাইলে বহু আগেই উৎপাদন আমেরিকায় সরিয়ে নিতে পারতেন—কম খরচের শ্রমের বদলে রোবট ব্যবহার করে চীনের বিকল্প তৈরি করা যেত। কিন্তু এখন অ্যাপল 'সময়ের চাপে' পড়েছে। ব্যয়ের বিষয়টাও বড় একটা বাধা।
ওয়েডবুশ সিকিউরিটিজের ড্যান আইভস, যিনি অ্যাপলের পক্ষের একজন বিশ্লেষক, বলেন—একটি আমেরিকান-নির্মিত আইফোনের দাম পড়তে পারে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ ডলার।
এ অবস্থায় কুকের সামনে কোনো সহজ পথ দেখা যাচ্ছে না—যিনি একসময় প্রশংসিত ছিলেন বিশ্ব রাজনীতির দুরূহ পরিস্থিতিতে পথ খুঁজে নিতে পারার জন্য। এখন তার সবচেয়ে বড় আশাই হতে পারে, ট্রাম্প হয়তো অ্যাপলের জন্য কোনও রকম ছাড়ের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু বাণিজ্য 'গ্যাংস্টারবাদের' এই যুগে ঠিক কে বিশেষ সুবিধা পাবে, সেটা বলা কঠিন।
চীনে অ্যাপলের গ্রহণযোগ্যতা কমছে, কিন্তু কোম্পানিটি এতটাই গভীরে ঢুকে পড়েছে যে সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়। পাশাপাশি, অ্যাপলের প্রধান পণ্য আইফোন দুই বাজারেই এখন কিছুটা পুরোনো ও অনুপ্রাণিতহীন বলে মনে হচ্ছে। যদি টিম কুক দ্রুত কোনও চমক দেখাতে না পারেন, তাহলে তার নিজের প্রায় ১৪ বছরের এই স্বর্ণযুগও বাসি মনে হতে শুরু করবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন