ট্রাম্পের শুল্কারোপের সিদ্ধান্তকে 'বড় আঘাত' বলে সমালোচনা বিশ্ব নেতাদের

ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশকারী সব পণ্যের ওপর ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত 'বিশ্ব অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত'। খবর বিবিসি'র
তার এই মন্তব্য যেন চীনসহ অন্যান্য অনেক দেশের বক্তব্যের প্রতিধ্বনি। চীন ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছে এবং হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে 'পাল্টা কঠোর ব্যবস্থা' নেবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ৫ এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপর ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার পর তারা এ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
আগামী ৯ এপ্রিল থেকে প্রায় ৬০টি দেশেও চড়া শুল্ক আরোপ করা হবে।
ট্রাম্প বলেন, এসব পদক্ষেপ অন্যায্য বাণিজ্য নীতির প্রতিশোধ এবং তিনি এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় 'অত্যন্ত সদয়' ছিলেন।
মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট বলেন, এসব শুল্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাতকে উন্নত করতে ব্যবহার করা হবে।
বুধবার তিনি বলেন, এই পদক্ষেপ 'আমেরিকাকে আবার ধনী করে তুলবে'।
বৃহস্পতিবার সকালে এক বিবৃতিতে ভন ডার লেন বলেন, নতুন কর আমদানিতে 'অনিশ্চয়তা বাড়াবে' এবং 'বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য ভয়াবহ' পরিণতি ডেকে আনবে।
তিনি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর ফেলা প্রভাবের ওপর জোর দিয়ে বলেন, এই দেশগুলোর মধ্যে কয়েকটি দেশ এখন সর্বোচ্চ মার্কিন শুল্কের অধীনে রয়েছে।
ইউরোপ একটি ঐক্যবদ্ধ পদ্ধতি গ্রহণ করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউরোপীয় কমিশন প্রধান।
তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) - যা ২০ শতাংশ শুল্কের আওতায় থাকবে – এর আলোচনা ব্যর্থ হলে তারা পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি বলেন, 'আপনি আমাদের একজনকে আক্রমণ করলেন, মানে আপনি আমাদের সবাইকে আক্রমণ করছেন।'
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান বার্নড ল্যাঞ্জ বলেন, আগামী সপ্তাহে ইইউর বিভিন্ন সদস্য দেশের মধ্যে আলোচনা শুরু হবে।
ট্রাম্পের মিত্র ইতালির জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, সিদ্ধান্তটি 'ভুল'। তবে তিনি 'বাণিজ্য যুদ্ধ এড়াতে' যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তি করার চেষ্টা করবেন।
অন্যদিকে স্প্যানিশ প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ বলেছেন, স্পেন 'একটি উন্মুক্ত বিশ্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে'।
অন্যদিকে আয়ারল্যান্ডের তাইওসিচ মিশেল মার্টিন বলেছেন, ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত 'গভীর দুঃখজনক' এবং এতে 'কোনো পক্ষই লাভবান নয়'।
প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বৃহস্পতিবার এলিসি প্রাসাদে নতুন করের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন।
ফ্রান্স সরকারের মুখপাত্র সোফি প্রিমাস বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, ফ্রান্স 'এই বাণিজ্য যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত'।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরে ট্রাম্পের হিসেবে 'সবচেয়ে বেশি অপরাধী' হিসেবে বিবেচিত দেশগুলোর একটি হলো চীন। চীনের ২০% বিদ্যমান শুল্কের ওপর আরও ৩৪% শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। এর ফলে দেশটির ওপরে আরোপিত মোট শুল্ক কমপক্ষে ৫৪%-এ পৌঁছেছে।
চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রকে 'অবিলম্বে শুল্ক বাতিল' করার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, চীন 'নিজের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় কঠোর পাল্টা ব্যবস্থা নেবে'।
যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৩২ শতাংশ শুল্কের মুখে পরা তাইওয়ান এই পদক্ষেপকে 'অত্যন্ত অযৌক্তিক' বলে অভিহিত করেছে।
দেশটির প্রধানমন্ত্রী চো জুং-তাই বলেছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে 'গুরুতর প্রতিবাদ' জানাবেন।
দক্ষিণ কোরিয়ার ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হান ডাক-সু বলেছেন, বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ 'বাস্তবে পরিণত হয়েছে'।
তিনি জানান, ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের জেরে তারা বিপর্যস্ত। তার সরকার 'বাণিজ্য সংকট কাটিয়ে ওঠার' উপায় খুঁজছে।
জাপান বলেছে, তাদের ওপর ২৪% শুল্ক আরোপ 'অত্যন্ত দুঃখজনক' এবং এ সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং মার্কিন-জাপান চুক্তি লঙ্ঘিত হতে পারে।
অন্যদিকে, থাইল্যান্ড বলেছে যে তারা তাদের ওপর ৩৬% শুল্ক আরোপ নিয়ে আলোচনা করবে।
ইসরায়েলের অর্থনৈতিক কর্মকর্তারা, যারা এই ঘোষণার আগে আমেরিকান পণ্য আমদানির ওপর সব ধরনের শুল্ক বাতিল করেছিল, তাদের ওপর ১৭% শুল্ক আরোপের ফলে 'পুরোপুরি হতবাক' বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানিয়েছেন।
দেশটির একজন কর্মকর্তা স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেছেন, 'আমরা নিশ্চিত ছিলাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর শুল্ক পুরোপুরি বাতিল করার সিদ্ধান্ত, এই পদক্ষেপ থেকে আমাদের বাঁচাবে।'
হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু দেশের ওপর পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে তারা। যেমন- চীন মার্কিন পণ্যগুলোর ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করে, মার্কিন বাণিজ্যে 'অ-শুল্ক' বাধা আরোপ করে বা এমন কিছু কার্যকলাপ করে, সরকার যেগুলোকে মার্কিন অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলোকে বাধাগ্রস্ত করে বলে মনে করে।
১০ শতাংশ ন্যূনতম শুল্কের অধীনে থাকা দেশগুলোর নেতারাও ট্রাম্পের পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্থনি অ্যালবানিজ বলেছেন, 'অযৌক্তিক শুল্ক' আরোপের জন্য শেষ পর্যন্ত আমেরিকানদের সবচেয়ে বড় মূল্য দিতে হবে।
তবে তার সরকার পাল্টা শুল্ক আরোপ করবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমরা এমন কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেব না।'
ডাউনিং স্ট্রিটের একটি সূত্র বিবিসিকে জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যের ওপর কম শুল্ক আরোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির 'সরকারের সাম্প্রতিক বাণিজ্য চুক্তির প্রচেষ্টার প্রমাণ'।
বৃহস্পতিবার সকালে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী স্যার কেয়ার স্টারমার পুনর্ব্যক্ত করেছেন, শুল্কের প্রভাব প্রশমিত করতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে 'লড়াই করবেন'।
তিনি ব্যবসায়ী নেতাদের বলেন, এই পদক্ষেপগুলোর ফলে 'তার দেশে এবং বিশ্বব্যাপী উভয় জায়গায়ই' 'অর্থনৈতিক প্রভাব' পড়বে।
তবে তার সরকার 'ঠান্ডা ও সুশৃঙ্খলভাবে' প্রতিক্রিয়া জানাবে বলেও জানান তিনি।
লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিল বুধবার কংগ্রেসে ট্রাম্পের আরোপিত ১০ শতাংশ শুল্ক মোকাবিলায় 'অর্থনৈতিক পারস্পরিকতা আইন' -নামে একটি আইন অনুমোদন করেছে।
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আশ্রয় নেওয়াসহ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে পারস্পরিকতা নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ মূল্যায়ন করবে।
ট্রাম্পের ঘোষণার পরপরই মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট দেশগুলোর প্রতি সতর্কতা জানিয়ে বলেছেন, তারা যেন 'প্রতিশোধ না নেয়' এবং 'এটি মেনে নেয়'।
ফক্স নিউজকে তিনি বলেন, 'কারণ আপনারা যদি প্রতিশোধ নিতে চান, তবে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।'
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, বুধবারের ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় দুই বাণিজ্য অংশীদার কানাডা ও মেক্সিকোর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
রাশিয়া ও তার মিত্র উত্তর কোরিয়াকেও নতুন করে শুল্ক আরোপ করা দেশগুলোর তালিকায় দেখা যায়নি।
হোয়াইট হাউস বলেছে, তারা পূর্ববর্তী নির্বাহী আদেশ অনুসারে উভয় দেশকে [মেক্সিকো ও কানাডা] মোকাবিলা করবে। ফেন্টানিল এবং সীমান্ত সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এই দুই দেশের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিল ট্রাম্প।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি বলেছেন, কানাডা শুল্কের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে না।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে গাড়ির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের মতো পদক্ষেপগুলো 'লাখ লাখ কানাডীয়কে সরাসরি প্রভাবিত করবে' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে এই শুল্কের বিরুদ্ধে লড়াই করার' প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
তিনি আরও বলেন, মার্কিন শুল্ক 'বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করবে'।