মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির হাতছানি দেওয়া হারিয়ে যাওয়া মানচিত্র

২০০৮ সালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ফিলিস্তিনি নেতা মাহমুদ আব্বাসকে এক শান্তিচুক্তিতে সম্মত হতে অনুরোধ করেছিলেন। তার মতে, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আনতে পারত। খবর বিবিসির
আব্বাসকে ওলমার্ট বলেছিলেন, 'আগামী ৫০ বছরেও আপনি এমন কোনো ইসরায়েলি নেতা পাবেন না, যিনি আপনাকে এই প্রস্তাব দেবেন। এতে স্বাক্ষর করুন এবং ইতিহাস বদলে দিন!'
এটি ছিল দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের একটি পরিকল্পনা, যা আজ প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৯৪ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হতো।
ওলমার্টের তৈরি মানচিত্রটি এতদিন কিংবদন্তির মতো ছিল। পূর্বে বিভিন্ন ব্যাখ্যা প্রকাশ পেলেও, তিনি কখনোই এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করেননি।

সম্প্রতি, নর্মা পার্সির ডকুমেন্টারি সিরিজ 'ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন: ৭ অক্টোবরের পথে'-তে প্রথমবারের মতো ওলমার্ট সেই মানচিত্রটি প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি প্রথমবারের মতো আমি গণমাধ্যমে প্রকাশ করছি।'
ওই মানচিত্রে দেখা যায়, পশ্চিম তীরের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ ভূখণ্ড ইসরায়েলের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল, যেখানে বড় ইহুদি বসতিগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিনিময়ে ইসরায়েলও পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার সংলগ্ন এলাকায় ফিলিস্তিনকে সমপরিমাণ জমি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
এছাড়া, পূর্বের আলোচনার মতোই দুই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে সংযুক্ত করতে একটি সুড়ঙ্গ বা মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাবও ছিল।
ওই বৈঠকে মাহমুদ আব্বাস চুক্তিটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন বলে স্মৃতিচারণ করেন ওলমার্ট। তার পরিকল্পনায় জেরুজালেম সমস্যারও একটি সমাধান ছিল। উভয় পক্ষ শহরের কিছু অংশ নিজেদের রাজধানী হিসেবে দাবি করতে পারবে, আর 'পবিত্র ক্ষেত্র'-এর প্রশাসন একটি ট্রাস্টি বোর্ডের হাতে থাকবে। এই বোর্ডে ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, জর্ডান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা থাকবেন।
চুক্তিটি বাস্তবায়িত হলে পশ্চিম তীর ও জর্ডান উপত্যকার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ইহুদি বসতি খালি করতে হতো। ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন গাজা উপত্যকা থেকে কয়েক হাজার ইহুদি বসতি সরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি আরও কঠিন ছিল, কারণ সেখানে হাজার হাজার বসতি উচ্ছেদ করতে গেলে চরম সহিংসতার আশঙ্কা ছিল।
কিন্তু এই চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। মাহমুদ আব্বাস স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ তিনি তাঁর বিশেষজ্ঞদের মতামত নিতে চেয়েছিলেন। বৈঠকের পর আব্বাস এতে স্বাক্ষর না করায় ওলমার্ট মানচিত্রের অনুলিপি দিতে অস্বীকৃতি জানান।
তিনি বলেন, 'তাঁরা পরদিন মানচিত্র বিশেষজ্ঞদের একটি বৈঠকের ব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন। আমরা এমনভাবে বিদায় নিয়েছিলাম, যেন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি।'
কিন্তু সেই বৈঠক আর হয়নি। সেদিন রাতে জেরুজালেম থেকে ফেরার সময় আব্বাসের চিফ অব স্টাফ রফিক হুসেইনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, 'আমরা তখন হাসছিলাম।'
ওলমার্ট তখন দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং ইতোমধ্যেই পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ফলে ফিলিস্তিনিরা ধরে নিয়েছিল যে এই পরিকল্পনার আর কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

হুসেইনি বলেন, 'ওলমার্ট ভালো মানুষ হলেও তখন তিনি ছিলেন ক্ষমতাহীন। তাই পরিকল্পনাটি এগিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।'
গাজা পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও জটিল করেছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে, হামাস-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে মাসের পর মাস রকেট হামলার পর, ওলমার্ট ইসরায়েলের সামরিক অভিযান 'অপারেশন কাস্ট লিড' শুরু করার নির্দেশ দেন। তিন সপ্তাহ ধরে তীব্র সংঘর্ষ চলে।
ওলমার্টের মতে, আব্বাসের উচিত ছিল চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। তাহলে ভবিষ্যতে কোনো ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী চুক্তি বাতিল করতে চাইলে তিনি (আব্বাস) বিশ্বকে বলতে পারতেন যে, ব্যর্থতার দায় ইসরায়েলের।
এরপর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের নির্বাচনে লিকুদ পার্টির নেতা বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ছিলেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধী। ফলে, ওলমার্টের পরিকল্পনা এবং সেই মানচিত্র ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়।
ওলমার্ট বলেন, 'আমি এখনো আব্বাসের উত্তরের অপেক্ষায় আছি। তবে এই পরিকল্পনাও বহু ব্যর্থ প্রচেষ্টার তালিকায় যুক্ত হয়েছে, যা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সমাধান করতে পারত।'
১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের প্রখ্যাত কূটনীতিক অ্যাব্বা এবান রসিকতা করে বলেছিলেন, 'ফিলিস্তিনিরা কখনোই একটি সুযোগ হাতছাড়া করার সুযোগ হাতছাড়া করে না।' পরবর্তী কয়েক দশকে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বারবার এই উক্তি উদ্ধৃত করেছেন।
কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল, বিশেষ করে ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর থেকে।
হোয়াইট হাউসে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিন ও ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের ঐতিহাসিক করমর্দনের মধ্য দিয়ে শান্তি প্রক্রিয়ায় আশার আলো দেখা গিয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়।
এই ব্যর্থতার কারণ জটিল এবং উভয় পক্ষের একে অপরকে দোষারোপ করার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। তবে প্রকৃতপক্ষে, পরিস্থিতি কখনোই ব্যাটে-বলে মেলেনি। ওলমার্ট ২৪ বছর আগে নিজেই এই প্রতিকূলতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
২০০১ সালের জানুয়ারিতে মিশরের রিসোর্ট শহর তাবায় ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি আলোচকরা আবারও সমঝোতার একটি রূপরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। এক ফিলিস্তিনি আলোচক একটি তোয়ালেতে মানচিত্র এঁকে বলেছিলেন, 'প্রথমবারের মতো আমরা একটি বাস্তবসম্মত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা দেখতে পাচ্ছি।'
কিন্তু সেই আলোচনা অর্থহীন হয়ে যায়, কারণ পশ্চিম তীর ও গাজায় দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি বিদ্রোহ 'ইন্তিফাদা' সহিংসতায় রূপ নেয়।
সেই সময় ইসরায়েলও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক পদত্যাগ করেছিলেন এবং কিছু সপ্তাহের মধ্যেই এরিয়েল শ্যারন ক্ষমতায় বসেন।
তোয়ালেতে আঁকা সেই মানচিত্র ওলমার্টের মানচিত্রের মতোই ইতিহাসের পাতায় একটি সম্ভাবনার গল্প হয়েই রয়ে গেছে।