ইরানের হিসেবের ভুল, যে কারণে ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
ইরানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ভুল হিসেবের কারণেই ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা ব্যর্থ হলে ইসরায়েল হামলা চালাতে পারে—এই আশঙ্কায় ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু তারা একটি গুরুতর ভুল হিসাব করেছিলেন।
শুক্রবার ইরানের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, তারা ধারণাও করতে পারেননি ওমানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার পরবর্তী ধাপ শুরু হওয়ার আগেই ইসরায়েল আক্রমণ করবে।
হামলা সম্পর্কিত খবরকে তারা সেসময়ে ইসরায়েলের অতিরঞ্জন বলে মনে করেছিলেন। ভেবেছিলেন এটি আলোচনার টেবিলে তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে পারমাণবিক কর্মসূচিতে আরও ছাড় দিতে বাধ্য করার কৌশল। এখন তারা বলছেন, এই ধরনের আত্মপ্রসাদই কাল হয়েছে। ফলে তারা আগেভাগেই সব ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিতে পারেননি।
ইসরায়েল শুক্রবার ইরানের বিভিন্ন স্থানে যে ব্যাপক হামলা চালায়, তার আগের প্রস্তুতি এবং পরে ইরানের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল—তা উঠে এসেছে ছয়জন শীর্ষ ইরানি কর্মকর্তা ও বিপ্লবী গার্ডের দুই সদস্যের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বিবরণে। সংবেদনশীল তথ্য নিয়ে আলোচনা করায় সবাই নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন।
তারা জানান, হামলার রাতে জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডাররা নিরাপদ আশ্রয়ে না গিয়ে নিজেদের বাসায় ছিলেন—যা ছিল এক মারাত্মক ভুল। বিপ্লবী গার্ডের অ্যারোস্পেস ইউনিটের কমান্ডার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ এবং তার শীর্ষ সহকর্মীরা 'একত্রে অবস্থান না করার' নির্দেশনা উপেক্ষা করে তেহরানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে জরুরি যুদ্ধ বৈঠক করেন। পরে সেই ঘাঁটিতে ইসরায়েলি হামলায় তারা নিহত হন।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ইরান সরকার বুঝতে শুরু করে, দিনের প্রথম প্রহরে শুরু হওয়া ইসরায়েলি সামরিক অভিযান কতটা ভয়াবহ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির অন্তত ১৫টি জায়গায় হামলা হয়েছে। ইসফাহান, তাবরিজ, ইলাম, লোরেস্তান, বোরুজের্দ, কোম, আরাক, উরুমিয়া, কাসরে শিরিন, কেরমানশাহ, হামেদান ও শিরাজসহ একাধিক শহরে হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন ইরানের চারজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা।
তাদের ভাষায়, ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বড় একটি অংশ অকার্যকর করে দেয়—রাডার ও আকাশ প্রতিরক্ষা ধ্বংস করা হয়, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহারে অক্ষম করে ফেলা হয় এবং সামরিক কমান্ড শৃঙ্খলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে, নাতাঞ্জের একটি প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধিকরণ কেন্দ্রে ভূপৃষ্ঠের অংশ ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের হাতে থাকা অভ্যন্তরীণ বার্তা আদান-প্রদানের স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছেন, "আমাদের আকাশ প্রতিরক্ষা কোথায়?" বা "ইসরায়েল কীভাবে ইচ্ছেমতো যেকোনো জায়গায় হামলা চালিয়ে আমাদের শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যা করতে পারে, আর আমরা কিছুই করতে পারি না?" তারা গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মারাত্মক ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন—যার কারণে আগাম কোনো সংকেত ছাড়াই হামলা হয়েছে এবং এত বড় ক্ষতি হয়েছে।
"ইসরায়েলের হামলা পুরোপুরি আমাদের নেতৃত্বকে অপ্রস্তুত করে ফেলে—বিশেষ করে আমাদের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যার বিষয়টি," বলেন তেহরান থেকে ফোনে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশটির চেম্বার অব কমার্সের জ্বালানি কমিটির সদস্য হামিদ হোসেইনি।
সরকারের ঘনিষ্ঠ এই ব্যক্তি আরও বলেন, ইরানের নিরাপত্তা ও সামরিক কাঠামোয় ইসরায়েলের এমন গভীর অনুপ্রবেশ নেতাদের চমকে দিয়েছে। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই ইরানে ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে গোপনে সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য করে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে আসছিল। কিন্তু শুক্রবারের বহুমুখী, জটিল এই হামলা—যাতে যুদ্ধবিমান এবং ভেতরে অনুপ্রবেশকারী এজেন্টরা ব্যবহৃত হয়, যারা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের যন্ত্রাংশ পাচার করে এনেছিল—তা ইসরায়েলের সক্ষমতার এক নতুন মাত্রা দেখিয়েছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, যাঁকে বর্তমানে একটি অজ্ঞাত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেখান থেকেই তিনি শীর্ষ সামরিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ইসরায়েল এই হামলার মাধ্যমে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
প্রতিশোধ ও শাস্তির হুমকি দিয়ে খামেনি বলেন, ইরান তেলআবিব ও জেরুজালেম লক্ষ্য করে একাধিক ধাপে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। "তারা যেন মনে না করে হামলা করে পার পেয়ে যাবে," বলেন খামেনি। "না, যুদ্ধ শুরু করেছে ওরাই। তারা শুরু করেছে। এই অপরাধ করে তারা রেহাই পাবে না—আমরা তা হতে দেব না।"
শুক্রবার সকালে, ইরানের সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল—২৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক নীতিনির্ধারক পরিষদ জরুরি বৈঠকে বসে, যেখানে আলোচ্য বিষয় ছিল: দেশ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। বৈঠক সম্পর্কে অবগত দুই কর্মকর্তার মতে, খামেনি প্রতিশোধ নিতে চাইলেও তা হুট করে করতে চাননি।
বৈঠকে দ্বিধাবিভক্তি দেখা দেয়—ইরান কখন, কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে? ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব কিনা? কারণ, ইরানের প্রতিরক্ষা ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একজন কর্মকর্তা বৈঠকে বলেন, যদি ইসরায়েল পাল্টা জবাবে ইরানের বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ অবকাঠামোয় হামলা চালায়, তাহলে দেশে বিক্ষোভ বা দাঙ্গার আশঙ্কা রয়েছে।
বৈঠকে উপস্থিত বিপ্লবী গার্ডের এক সদস্য বলেন, কর্মকর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, খামেনি তার প্রায় ৪০ বছরের শাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে: হয় তাকে কার্যকর প্রতিক্রিয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে—যা তার শাসনের অবসান ডেকে আনতে পারে; অথবা তাকে পিছু হটতে হবে—যা দেশ-বিদেশে পরাজয়ের স্বীকৃতির সমান।
আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষণ সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ'-এর ইরান প্রকল্প পরিচালক আলি ভায়েজ বলেন, "খামেনির সামনে কোনো সহজ পথ নেই। তিনি উত্তেজনা বাড়ালে, ইসরায়েলের আরও ভয়াবহ হামলার ঝুঁকি রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়তে পারে। আর যদি তিনি কিছু না করেন, তাহলে নিজেই নিজের শাসনের ভিত খালি করে ফেলবেন।"
গার্ডের দুই সদস্য জানান, প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল, এক হাজারের মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কার্যত অকেজো করে দেওয়া এবং সর্বোচ্চ ক্ষতি নিশ্চিত করা। কিন্তু ইসরায়েলের হামলায় ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলো এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, স্টোরেজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে লঞ্চার মোতায়েন করার সুযোগই পাওয়া যায়নি।
ফলে শেষ পর্যন্ত, ইরান হামলার প্রথম ধাপে প্রায় ১০০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে সক্ষম হয়। তেল আবিবের আশপাশে অন্তত সাতটি স্থানে আঘাত হানে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো। এতে একজন নিহত, অন্তত ২০ জন আহত হন এবং আবাসিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কর্মকর্তারা জানান, দিনভর ইসরায়েলি হামলা কিছুটা স্তিমিত হওয়ার পর, ইরানের সেনাবাহিনী দ্রুত কিছু ক্ষতিগ্রস্ত বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা মেরামত করে এবং নতুন করে বসায়। আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়; সব ফ্লাইট স্থগিত এবং বিমানবন্দরগুলোও সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়।
তেহরানের অনেক বাসিন্দা সেদিন তাদের গাড়ির ট্যাংক পূর্ণ করতে গ্যাস স্টেশনে দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করেন এবং মুদি দোকানে ভিড় করে রুটি, টিনজাত খাবার ও বোতলজাত পানি মজুত করেন। অনেক পরিবার গভীর রাত পর্যন্ত পার্কে অবস্থান করে, ঘাসে কম্বল বিছিয়ে পিকনিক করে। টেলিফোনে তারা জানান, ইসরায়েল বিভিন্ন এলাকায় বিজ্ঞানী ও সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে আবাসিক ভবনে হামলা চালানোয় তারা ঘরে থাকতে ভয় পেয়েছিলেন।
৩৫ বছর বয়সী মেহেরদাদ তার রান্নাঘরের দেয়াল ও জানালার ধ্বংসস্তূপের ভিডিও শেয়ার করেন। তিনি জানান, তেহরানের উত্তরাঞ্চলে তার বাড়ির পাশের একটি উঁচু ভবনে ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানলে এই ক্ষতি হয়। হামলার সময় তিনি শোবার ঘরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান, তবে তার এলাকায়, শিশুসহ, কয়েকজন বেসামরিক নাগরিক আহত হন।
