যেভাবে রাশিয়ার ‘ত্রিভুজ’ রণকৌশল ন্যাটোর জন্যেও উদ্বেগের কারণ

ইউক্রেন যুদ্ধের চতুর্থ বছরে রাশিয়া এমন একটি কার্যকর পদ্ধতি খুঁজে পেয়েছে, যা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে পারে।
ব্রিটিশ সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, পদাতিক বাহিনী, ড্রোন এবং গ্লাইড বোমার সমন্বয়ে গঠিত এই 'ত্রিভুজ আক্রমণ' প্রতিহত করতে ইউক্রেন হিমশিম খাচ্ছে। এ পরিস্থিতি ন্যাটোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।
তবে ধারাবাহিক অগ্রগতি অর্জন ছাড়া এই রুশ রণকৌশল এখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো বড় সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। রাশিয়ার প্রধান লক্ষ্য ইউক্রেনীয় সেনাদের চাপে রাখা ও তাদের মনোবল দুর্বল করা। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসন অস্ত্র সরবরাহ ও গোয়েন্দা সহায়তা স্থগিত করায় ইউক্রেন আরও সংকটে পড়েছে। এই কৌশলের তিনটি প্রধান উপাদান রয়েছে।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাংক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট (আরইউএসআই)-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, 'প্রথমত, রুশ সেনাবাহিনী (এএফআরএফ) পদাতিক ও মেকানাইজড ইউনিটের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ত রেখে তাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে।'
দ্বিতীয়ত, তারা ফার্স্ট-পারসন ভিউ ড্রোন (এফপিভি), ল্যানসেট ড্রোন, উচ্চ-বিস্ফোরক শেল এবং ছড়িয়ে পড়া মাইন ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় বাহিনীর চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে ও তাদের ক্ষয়ক্ষতি বাড়াচ্ছে।
তৃতীয়ত, রুশ বাহিনী এখন ইউক্রেনীয় প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ব্যাপকভাবে 'ইউএমপিকে গ্লাইড বোমা' ব্যবহার করছে। সাধারণ বোমার সঙ্গে ডানা ও ন্যাভিগেশন গাইড সংযুক্ত করে এই বোমাগুলোকে স্মার্ট বোমায় রূপান্তরিত করা হয়।
এর ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনী এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন—তারা কি ড্রোন ও কামানের হামলা এড়াতে স্থির প্রতিরক্ষা অবস্থান বজায় রাখবে, নাকি গ্লাইড বোমার বিধ্বংসী হামলা থেকে বাঁচতে অবস্থান পরিবর্তন করবে?
এই রণকৌশলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে রাশিয়ার বিমান বাহিনীর ভূমিকা বৃদ্ধির মাধ্যমে। যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়া আশা করেছিল যে তাদের বিমান শক্তি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেবে। কিন্তু ইউক্রেনের শক্তিশালী বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রুশ যুদ্ধবিমানগুলোর কার্যকারিতা প্রায় অকার্যকর করে দেয়, ফলে সেগুলো সাধারণত ফ্রন্টলাইন থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করত।
তবে এখন রাশিয়া অপেক্ষাকৃত নিম্ন-প্রযুক্তির অস্ত্র ব্যবহার করে তাদের বিমান শক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। গ্লাইড বোমাগুলো মূলত প্রচলিত লোহার বোমা, যেগুলোতে ডানা ও জিপিএস নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যুক্ত করে ইউএমপিকে কিটের মাধ্যমে স্মার্ট বোমায় পরিণত করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র গত ২৫ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে এ ধরনের জয়েন্ট ডাইরেক্ট অ্যাটাক মিউনিশন (জেডিএএম) ব্যবহার করে আসছে।
২০২৩ সালে রাশিয়ার গ্লাইড বোমার ব্যবহার পশ্চিমা বিশ্লেষকদের বিস্মিত করেছিল। আরইউএসআই বলছে, 'প্রথমদিকে এগুলোকে স্বতন্ত্রভাবে খুব বিপজ্জনক মনে করা হয়নি, বরং রাশিয়ার দুর্বলতার প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়েছিল। কিন্তু এই অস্ত্র ব্যাপক হারে উৎপাদনযোগ্য হওয়ায় এটি রাশিয়ার জন্য কৌশলগত সুবিধায় পরিণত হয়েছে।'
বর্তমানে রুশ বিমান বাহিনী ৩০ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরত্বে থেকে ফ্রন্টলাইনের ওপারে এসব গ্লাইড বোমা নিক্ষেপ করছে, ফলে তাদের বিমানগুলো ইউক্রেনীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাগালের বাইরে থাকছে।
রাশিয়ার গ্লাইড বোমাগুলো পশ্চিমা অস্ত্রগুলোর মতো একেবারে নির্ভুল না হলেও, বিস্ফোরণ ক্ষমতায় এগিয়ে। সাধারণত জেডিএএম-এর ওজন ৫০০ থেকে ২ হাজার পাউন্ডের মধ্যে থাকে, তবে রাশিয়ার 'ফ্যাব-১৫০০' প্রায় ৩ হাজার ৫০০ পাউন্ড ওজনের, আর 'ফ্যাব-৩০০০' ওজন ৬ হাজার পাউন্ডেরও বেশি।
এই বোমাগুলোর ধ্বংসক্ষমতা এতটাই বেশি যে, লক্ষ্যবস্তুতে সরাসরি আঘাত না করলেও ইউক্রেনের পরিখা ও বাঙ্কার ধ্বংস করতে পারে। আরইউএসআই'র মতে, '২০২৪ সালে ৪০ হাজার ইউনিট থেকে চলতি বছরে ৭০ হাজার ইউনিট গ্লাইড বোমা উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে রুশ হামলায় ইউক্রেনীয় সেনাদের প্রাণহানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
ফলে ইউক্রেনীয় বাহিনী নিজেদের অবস্থান রুশ নজরদারি থেকে সম্পূর্ণ গোপন রাখার চেষ্টা করছে, ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হচ্ছে এবং শত্রুকে দূর থেকে প্রতিহত করতে চালকবিহীন বা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ওপর নির্ভর করছে।'
রাশিয়া এখন ভূমি ও আকাশে একযোগে হামলা পরিচালনা করছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সামরিক বাহিনীর একটি প্রচলিত কৌশল। যুদ্ধের বেশিরভাগ সময় রাশিয়া সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ব্যয়বহুল ড্রোন এবং গ্লাইড বোমার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তুলনামূলক কমসংখ্যক সেনা ও কম অস্ত্রশক্তি নিয়েও ইউক্রেন এই হুমকি মোকাবিলা করেছিল।
কিন্তু এখন রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী, ড্রোন ও গ্লাইড বোমার সমন্বিত হামলা প্রতিহত করা ইউক্রেনের জন্য আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
তবে রাশিয়ার এই 'ত্রিভুজ আক্রমণ' তাদের সামরিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার কোনো নিখুঁত সমাধান নয়। রুশ বাহিনী এখনও কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতায় ভুগছে। পাশাপাশি, এটি রাশিয়ার জন্য কোনো বড় বিজয়ও বয়ে আনতে পারেনি। ইউক্রেন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ড্রোন এবং দূর-পাল্লার অস্ত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার অগ্রসর বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে।
আরইউএসআই বলছে, 'ইউক্রেনের বহুস্তর প্রতিরক্ষা কৌশল এবং দূর থেকে শত্রুকে দুর্বল করার পরিকল্পনা রুশ বাহিনীর জন্য অগ্রসর হওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে রাশিয়া প্রতিরক্ষা সীমানা ভাঙতে বা যুদ্ধের গতি বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।'
পশ্চিমা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ন্যাটোর উচিত রাশিয়ার বিমান হামলা থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং বহুসংখ্যক সস্তা গ্লাইড বোমার মজুদ গড়ে তোলা। তবে রাশিয়া যে সুবিধাগুলো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে পাচ্ছে, সেগুলো ন্যাটোর সঙ্গে যেকোনো সম্ভাব্য সংঘাতে কার্যকর নাও হতে পারে। বিশেষ করে, ইউক্রেনের শক্তিশালী বিমান বাহিনী বা দূর-পাল্লার আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্রের অভাবে রুশ যুদ্ধবিমান ফ্রন্টলাইন থেকে ৬০ মাইল পিছনে থেকে নিরাপদে গ্লাইড বোমা নিক্ষেপ করতে পারছে।
কিন্তু ন্যাটোর বিমান বাহিনী অনেক বেশি শক্তিশালী, আকাশযুদ্ধে দক্ষ এবং প্রতিপক্ষের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দমন ও সৈন্য ও সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করতে সক্ষম।