হঠাৎ সামরিক পোশাকে পুতিন: যুদ্ধবিরতির না বিরোধিতার ইঙ্গিত, না অন্য কিছু?

২৫ বছর ধরে ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে এক দৃঢ় ও আপসহীন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ক্রেমলিনের প্রচারণায় তাকে কখনো জুডো খেলতে, কখনো বরফের উপর হকি খেলায় গোল দিতে, কখনো খালি গায়ে ঘোড়ায় চড়তে দেখা গেছে।
তবে কেজিবির সাবেক এই কর্নেল, যিনি বর্তমানে রাশিয়ার সর্বোচ্চ সামরিক প্রধান, তাকে সচরাচর সামরিক পোশাকে দেখা যায়নি—অন্তত প্রকাশ্যে নয়।
তবে বুধবার সেই রীতি ভাঙল। রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় কুর্স্ক অঞ্চলের একটি সামরিক ঘাঁটিতে গিয়ে দেশটির শীর্ষ সেনাপ্রধান ভ্যালেরি গেরাসিমোভের পাশে সবুজ ক্যামোফ্লাজ পোশাকে দেখা গেল পুতিনকে।
গত আগস্টে ইউক্রেনীয় বাহিনী কুর্স্কের কয়েকশ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে নেয়, যেখানে সুদঝা শহর ২১৫ দিন তাদের দখলে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশের কোনো শহর বিদেশি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে যায়, যা পুতিনের 'তিন দিনে কিয়েভ দখলের' ঘোষণার পর বড় এক ধাক্কা হয়ে আসে।
এই সপ্তাহের শুরুতে রুশ বাহিনী এবং উত্তর কোরিয়ার সেনাদের সহায়তায় তারা সুদঝা পুনর্দখল করে। কিন্তু সীমান্তবর্তী কয়েকটি গ্রাম এখনো ইউক্রেনের দখলে। এমন প্রেক্ষাপটে কুর্স্ক সফরে গিয়ে সামরিক পোশাকে দেখা দিলেন পুতিন।
এর আগে ১৯৬৯ সালে, মস্কো-বেইজিং সীমান্ত সংঘর্ষের সময় চীনা বাহিনী স্বল্প সময়ের জন্য উস্সুরি নদীর একটি দ্বীপ দখল করেছিল।
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নাকচের ইঙ্গিত?
সুদঝা পুনরুদ্ধারের পর প্রথমবার কুর্স্ক সফরে যান পুতিন। তবে তার সামরিক পোশাক পরার বিষয়টি শুধুমাত্র এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া নয়, বরং আরও গভীর বার্তা বহন করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সমাপ্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের রিয়াদ আলোচনার প্রতি পুতিনের নীরব কিন্তু দৃঢ় 'না' বার্তা।
অনেকে এটিকে আলোচনার একটি 'বিকল্প' সংকেত হিসেবেও দেখছেন।
'রাশিয়ার শর্ত মানতে হবে, নতুবা প্রেসিডেন্ট সরাসরি যুদ্ধরত জাতির সর্বোচ্চ সামরিক কমান্ডারের ভূমিকা নেবেন,' মন্তব্য করেছেন প্রো-ক্রেমলিন মিডিয়া সেরগ্রাদ-এর বিশ্লেষক আন্দ্রেই পিনচুক।
এর আগে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরেও সামরিক ধাঁচের পোশাকে দেখা গিয়েছিল পুতিনকে, যখন তিনি রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নৌ ও সামরিক মহড়ায় অংশ নেন।
তবে সেই সময় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ দাবি করেছিলেন, পুতিনের পোশাক নির্বাচনের পেছনে একমাত্র কারণ ছিল 'ঠান্ডা ও বাতাসপূর্ণ আবহাওয়া'।

এক বছর আগে পেসকভ বলেছিলেন যে, কমান্ডার-ইন-চিফ হওয়া সত্ত্বেও পুতিনের 'সামরিক পোশাক পরার প্রয়োজন নেই,' এমনকি তিনি যদি সামরিক মহড়ায় উপস্থিত থাকেন তবুও।
কিয়েভে, এক ইউক্রেনীয় মনোবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞান সমিতির ভাইস-প্রেসিডেন্ট সভিতলানা চুনিখিনা মতে, পুতিনের সামরিক পোশাক পরার উদ্দেশ্য ছিল বোঝানো যে তিনি 'এইসব শান্তি উদ্যোগের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন এবং যুদ্ধে বিজয়ী হতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।'
তিনি আরও বলেন, 'যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের জবাবে পুতিন প্রথমবারের মতো সামরিক পোশাক পরলেন… কিন্তু প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করেই কেন তিনি তার বার্তা দ্বিগুণ জোরালো করার প্রয়োজন অনুভব করলেন?'
তার মতে, সামরিক পোশাকটি পুতিনের গায়ে বেশ ঢিলা ছিল, যা তাকে আরও ক্লান্ত ও বয়স্ক দেখিয়েছে। গত অক্টোবরেই তিনি ৭২ বছর পূর্ণ করেছেন। 'এটি আসলে একটি অতিরিক্ত সংকেত,' মন্তব্য করেন চুনিখিনা।
একজন ইউক্রেনীয় যুদ্ধ-বীরও একই মত পোষণ করেন।
'সত্যি বলতে, তাকে দেখতে একদম ইঁদুরের মতো লেগেছে। যেটা সে আসলেই—একটি বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকা ব্যক্তি, যে নারী ও শিশুদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে,' বলেন কারেন ওভসেপিয়ান, যিনি ২০২২ সালে পূর্বাঞ্চলীয় আভদিভকা শহরের কাছে গুরুতর আহত হয়ে যুদ্ধ থেকে অবসর নেন।
পুতিনের এই নতুন সাজ ইউক্রেনীয়দের মধ্যে ঠাট্টা-বিদ্রুপের জন্ম দিয়েছে।
কমেডিয়ান ইউরি ভেলিকি, যিনি প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পুরনো সহকর্মী এবং তার 'ডিস্ট্রিক্ট ৯৫' কমেডি গ্রুপের সদস্য ছিলেন, ইনস্টাগ্রামে তার অনুসারীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন—'পুতিনের ছবির সঙ্গে এক বন্দি রুশ সৈন্যের ওভারসাইজড সামরিক পোশাক পরা ছবির ১০টি পার্থক্য খুঁজে বের করুন।'
আরেক জায়গায় রসিকতা করে বলা হয়েছে, কৃশকায় পুতিনকে দেখে মনে হয়েছে যেন তিনি 'নিজেরই সস্তা চীনা নকল সংস্করণ', যা তার আগের ক্রেমলিনের ছবির সঙ্গে একেবারেই মেলে না।
কিয়েভভিত্তিক বিশ্লেষক ভিয়াচেস্লাভ লিখাচেভ মনে করেন, পুতিন আসলে জেলেনস্কির প্রতি ঈর্ষান্বিত, কারণ জেলেনস্কি সবসময় সবুজ সামরিক পোশাক পরেন। তাই 'তিনি জেলেনস্কির মতো সাজছেন।'
এটি শুধু পোশাক পরিবর্তন নয়, বরং একটি বার্তাও। লিখাচেভ বলেন, 'পুতিন বোঝাতে চাইছেন যে তিনি তার দামি স্যুট ছেড়ে সামরিক পোশাক পরতে পারেন। এর মাধ্যমে তিনি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকেও খোঁচা দিচ্ছেন।'
তিনি আরও বলেন, 'পুতিন দেখাতে চাইছেন যে রাশিয়ার ভাগ্য নির্ধারিত হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে, অস্ত্রের ধোঁয়ার মধ্যে—না যে কোনো বৈঠকে, না রিয়াদে, না ওভাল অফিসে।'
তবে, পুতিনের এই সামরিক পোশাক পরার বিষয়টি কেবল প্রতীকী নয়, এর একটি গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। বিশেষ করে, মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে শান্তি আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কুর্স্ক পুনর্দখলের গুরুত্ব তিনি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।
'শান্তি আলোচনা শুরুর আগে কুর্স্ক অঞ্চল মুক্ত করা কতটা জরুরি, তা বোঝা যায়—যদিও ইউক্রেনীয় বাহিনীর দখলে থাকা সব এলাকা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব না,' বলেছেন বিশ্লেষক লিখাচেভ।
ইউক্রেনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা দাবি করেছেন, পুতিন দীর্ঘদিন ধরেই ইউক্রেনকে বশে আনার স্বপ্ন লালন করে আসছেন।
'তিনি কঠোর এবং এমনভাবে আচরণ করেন যেন ইউক্রেনের ওপর তার এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে,' বলেছেন ইউরি ভিতরেঙ্কো, যিনি ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় জ্বালানি কোম্পানি নাফতোগাজের প্রধান থাকার সময় পুতিনের সঙ্গে একাধিকবার দীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
তিনি আরও বলেন, 'পুতিনের কাছ থেকে দয়া, পারস্পরিক সহযোগিতা বা আধুনিক বিশ্বের কোনো মূল্যবোধের আশা করা ভুল হবে'—২০২১ সালে রাশিয়ার পূর্ণমাত্রার আগ্রাসনের কয়েক মাস আগে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন।
যুদ্ধবিরতিতে 'শর্ত'
পুতিন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে সাড়া দিতে দুই দিন সময় নিলেন। তার জবাব ছিল কিছুটা 'হ্যাঁ', কিন্তু সন্দেহ ও শর্তে ঘেরা।
মজার বিষয় হলো, পুতিনের সামরিক পোশাকে উপস্থিতির দুই দিন পর, বৃহস্পতিবার তিনি শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেননি। বরং 'শর্তসাপেক্ষে' একে স্বাগত জানান।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, 'আমরা যুদ্ধবিরতির পক্ষে, তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী শান্তির জন্য হতে হবে এবং সংকটের মূল কারণগুলো বিবেচনায় নিতে হবে।'
এরপর তিনি শর্ত দেন—ইউক্রেনকে সেনা নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ বন্ধ করতে হবে, আর পশ্চিমা দেশগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে।
'আর কুর্স্ক অঞ্চলে এখনো যে ইউক্রেনীয় বাহিনী রয়েছে, তাদের কী হবে?'—এমন প্রশ্ন তোলেন পুতিন।
'আমরা যুদ্ধবিরতি চাই, তবে কিছু বিষয় আছে', বলে তিনি বক্তব্য শেষ করেন।
তবে এই মন্তব্য করার সময় পুতিন আর সামরিক পোশাকে ছিলেন না। বরং তার পুরনো রূপে—চিরচেনা স্যুট-টাই পরে এসেছিলেন।