কর্মজীবী নারীদের জন্য ২০২৫ সালের সেরা দেশ কোনগুলো?

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ৮ মার্চ দি ইকোনমিস্ট গ্লাস-সিলিং সূচক প্রকাশ করে। এই সূচকের মাধ্যমে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি)-এর ২৯টি দেশে নারীদের কর্মপরিবেশ মূল্যায়ন করা হয়।
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও নীতিনির্ধারণে কার্যকর ভূমিকা রাখা এই সংস্থার সদস্য দেশগুলোতে নারী কর্মশক্তির অবস্থা নির্ণয়ে ১০টি সূচকের ভিত্তিতে এই মূল্যায়ন করা হয়। এর মধ্যে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ, বেতন, মাতৃত্বকালীন ছুটি ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব উল্লেখযোগ্য।
২০২৪ সালের সূচকের তথ্যচিত্রে দেখা যায়, বিভিন্ন দেশ কীভাবে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা অর্জনে এগিয়েছে বা পিছিয়েছে।
২০২৪ সালে এই সূচকে শীর্ষস্থান দখল করেছে সুইডেন, যা আইসল্যান্ডের দুই বছরের শীর্ষস্থানীয় অবস্থানকে ছাপিয়ে গেছে। নর্ডিক দেশগুলো বরাবরই এই সূচকে এগিয়ে থাকে, কারণ তারা নারী ও কর্মজীবী অভিভাবকদের জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ করে।
বিপরীতে, দক্ষিণ কোরিয়া প্রথমবারের মতো সর্বনিম্ন অবস্থান থেকে উঠে এসে ২৮তম স্থানে পৌঁছেছে, আর তুরস্ক এবার তালিকার শেষ স্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে নিউজিল্যান্ড, যা আট ধাপ এগিয়ে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে।
শিক্ষা ও কর্মসংস্থান
ওইসিডি দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। গত বছর ৪৫ শতাংশ নারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়েছেন, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ছিল ৩৬ দশমিক ৯ শতাংশ।
এমবিএতে ভর্তির জন্য জিএমএটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী নারীদের হার ২০২৪ সালে ৩৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া ও নিউজিল্যান্ডে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে।
তবে, শিক্ষার এই অগ্রগতির পরও কর্মসংস্থানে নারীদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। বর্তমানে ৬৬ দশমিক ৬ শতাংশ কর্মক্ষম নারী চাকরিতে নিয়োজিত, যেখানে পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৮১ শতাংশ।
দেশভেদে এই হার ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়—আইসল্যান্ড ও সুইডেনে ৮২ শতাংশে বেশি নারী কাজ করেন, কিন্তু ইতালিতে এই হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। কর্মসংস্থানে কম অংশগ্রহণের ফলে নারীদের ক্যারিয়ার অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় এবং এটি বেতন বৈষম্যের অন্যতম কারণ। ওইসিডি দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীরা গড়ে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ কম বেতন পান। অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো কিছু দেশে এই ব্যবধান আরও বাড়ছে।

কর্পোরেট ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব
ব্যবসা ও রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে। ২০১৬ সালে কর্পোরেট বোর্ডের ২১ শতাংশ আসন নারীদের দখলে থাকলেও ২০২৪ সালে এটি বেড়ে ৩৩ শতাংশে পৌঁছেছে।
নিউজিল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে এখন নারী ও পুরুষ প্রায় সমান সংখ্যক বোর্ড সদস্যপদ দখল করছেন। তদ্রূপ, সুইডেন, লাটভিয়া ও আমেরিকায় নারীরা মোট ব্যবস্থাপনা পদের প্রায় অর্ধেক দখল করেছেন।
রাজনীতিতেও নারীদের উপস্থিতি বাড়ছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলোর পর প্রথমবারের মতো ওইসিডি দেশগুলোর সংসদে নারীদের উপস্থিতি ৩৪ শতাংশের ওপরে উঠেছে।
ব্রিটেনে ২০২৪ সালের জুলাই নির্বাচনে ৪৩ দবজন নতুন নারী এমপি নির্বাচিত হওয়ায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ৩৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪১ শতাংশে পৌঁছেছে। তবে জাপানে সংসদের মাত্র ১৬ শতাংশ সদস্য নারী, যদিও এটি দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
পরিবার ও মাতৃত্বকালীন সুবিধা
নারীদের কর্মজীবনে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে, যদিও এই সূচকটির ওজন তুলনামূলকভাবে কম দেওয়া হয়। কারণ, সব নারীই মা হন না। তবে যেসব দেশ কর্মজীবী মায়েদের জন্য সহায়ক নীতি গ্রহণ করে, সেসব দেশে নারীদের কর্মসংস্থান বেশি থাকে।
এই সূচকে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে, কারণ দেশটি এখনও জাতীয় পর্যায়ে মাতৃত্বকালীন ছুটির নিশ্চয়তা দেয় না এবং সেখানে শিশু পরিচর্যার খরচ গড়ে বেতনের ৩০ শতাংশের বেশি। নিউজিল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে এই খরচ সবচেয়ে বেশি—৩৭ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে, হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়ায় মায়েরা যথাক্রমে ৭৯ ও ৬৯ সপ্তাহের জন্য পূর্ণ বেতনের মাতৃত্বকালীন ছুটি পান।
পিতৃত্বকালীন ছুটিও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি কর্মস্থলে নারী-পুরুষের প্রতি বৈষম্য কমাতে সহায়তা করে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওইসিডি দেশগুলোর মধ্যে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় পিতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা সবচেয়ে বেশি, যদিও অনেক বাবা এ সুবিধা গ্রহণ করেন না।
গ্লাস-সিলিং সূচক কর্মজীবী নারীদের পরিস্থিতির একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরে। যদিও এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, বেশিরভাগ দেশই ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে এগোচ্ছে।
নারীরা কর্মসংস্থানে আরও বেশি অন্তর্ভুক্ত হলেও বেতন বৈষম্য ও ক্যারিয়ার অগ্রগতির বাধাগুলো এখনো স্পষ্ট। তবে, ইতিবাচক দিক হলো, ব্যবসা ও রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তন আনতে পারে।