নব্য-রক্ষণশীলরা ইউক্রেনে পরাজয়ের দায় ট্রাম্পের ওপর চাপাতে চাইছেন কেন

'বিশ্বাসঘাতকতা!'-- জার্মানির শীর্ষ বামপন্থী পত্রিকা ডের স্পিগেলের শিরোনামে যেন ধিক্কার, আর আর্তনাদ।
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় অ্যামব্রোজ ইভানস-রিচার্ড যে শিরোনামে কলাম লিখেছেন, বাংলায় তার অর্থ দাঁড়ায়— 'ট্রাম্পের পুতিনকে আলিঙ্গন হলো ইউরোপের জন্য মলোটভ-রিবেনট্রপ সংকট' (হিটলার ও স্টালিনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের যে চুক্তির মাধ্যমে ভাগাভাগি করা হয় পূর্ব ইউরোপকে, এই চুক্তি তাদের নামানুসারে মলোটভ-রিবেনট্রপ প্যাক্ট নামে পরিচিত)।
এমনকী ট্রাম্পপন্থী নিউইয়র্ক পোস্ট তার ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখের প্রথম পাতাজুড়ে ছেপেছে নব্য-রক্ষণশীল ওয়ার্ডস্মিথ ডগলাস মারের কলমে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনা।
যুদ্ধপন্থী শিবিরের এসব হুংকার শুনে মনে হবে, অন্ত নামছে পৃথিবীর বুকে। কিন্তু, এটা বিশ্বের অবসান নয়— এটা কেবল তাদের খেল খতমের মামলা। ব্যর্থতার হতাশা তাদের বুক চিড়ে ফেলছে, কারণ এরমধ্য দিয়ে ইতি টানা হচ্ছে— ইউক্রেনকে ব্যবহার করে রাশিয়ায় শাসকগোষ্ঠী পরিবর্তনের তাদের দুই দশকের প্রচেষ্টার। তারা ব্যর্থ কারণ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যত অস্ত্র উৎপাদন করেছে, রাশিয়ান ফেডারেশন একাই তার চেয়ে বেশি করেছে। রাশিয়ার অব্যাহত অগ্রযাত্রার মুখে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর শুধু খোলসটাই টিকে আছে।
এই অবস্থায়, যুদ্ধপন্থী শিবিরের একমাত্র আশা-ভরসা সব দোষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাঁধে চাপানো, এবং শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এই সংঘাতকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করা— যাতে স্থায়ী যুদ্ধবস্থা বিরাজমান থাকে।
বিশ্বজুড়ে চলমান অস্ত্র প্রতিযোগিতার লাগাম টানতে চান ট্রাম্প, এজন্য তিনি যে পরিকল্পনার প্রস্তাব দিয়েছেন— তার আওতায় কমানো যাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিপুল জাতীয় দেনা নিয়ে যে সংকট, সেটিও এড়ানো যাবে। কিন্তু, প্রতিরক্ষাখাতে লাগামহীন অর্থের স্রোত বন্ধ হলে— ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস বা লন্ডনের প্রতিরক্ষা এস্টাব্লিশমেন্টের স্থায়ী প্রতিনিধিদের বেকার হয়ে পড়তে হবে। ফলে এই এস্টাব্লিশমেন্ট বা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি বিনা যুদ্ধে ট্রাম্পকে ছাড় দেবে না।
বাইডেন প্রশাসন মনে করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার চাপে ধসে পড়ছে রাশিয়ার অর্থনীতি। ২০২২ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর ঘোষণায় বলেছিলেন, "রাশিয়ার অর্থনীতি অর্ধেক (কম) হওয়ার পথে রয়েছে।" কিন্তু, বাইডেন হোয়াইট হাউস ছাড়াও আগেই প্রমাণিত হয় নিষেধাজ্ঞা ব্যর্থ হচ্ছে। যেকারণে এমনকী ২০২১ সালের চেয়েও ২০২৪ সালে রাশিয়ার প্রকৃত জিডিপি ৬ শতাংশ বেশি হয়েছে। যুদ্ধ সরঞ্জাম উৎপাদনে সদাব্যস্ত রুশ অর্থনীতি এতই প্রাণবন্ত যে, মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ আসায় হয়েছে মূল্যস্ফীতি, আর তা নিয়ন্ত্রণে উচ্চ সুদহারও বেঁধে দিতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। এমনকী রুশরা প্রায় সব পণ্যই যুদ্ধের আগের সময়ের চেয়ে বেশি উৎপাদন ও ভোগ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারীরা— বিশ্বায়নপন্থী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও জেক সুলিভান থেকে শুরু করে ট্রাম্পের বরখাস্ত হওয়া সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ. আর. ম্যাকমাস্টার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেক ম্যাটিসের মতো নব্য-রক্ষণশীলরা— এরা সবাই ক্রমাগত দাবি করে গেছেন যে, পশ্চিমা বিশ্বের যথেষ্ট সহায়তা পেলে ইউক্রেন রাশিয়াকে গুঁড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু, তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করতেন, এবং মারাত্মক ভ্রমের মধ্যে ছিলেন।
যুদ্ধের কারণে পশ্চিম ইউরোপ পায়নি রুশ জ্বালানি, উল্টো তার সুবিধা পেয়েছে এশিয়া। ভারত ও চীনের মতো এশীয় অর্থনীতি ছাড়কৃত মূল্যের রাশিয়ান তেল ও গ্যাস কিনে খুবই লাভবান হয়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি জার্মান বার্তাসংস্থা ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়:
২০২১ সালে রাশিয়ার রপ্তানির ৫০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় দেশগুলোতে… অথচ ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, অর্থাৎ যুদ্ধ শুরুর দুই বছর পরে এসে, এই চিত্র পুরোপুরি পাল্টে যায়। সাম্প্রতিক সময়ের প্রকাশিত বাণিজ্যিক তথ্যানুসারে, রাশিয়ার প্রধান দুই রপ্তানি বাজার এখন চীন ও ভারত, যেখানে মোট রপ্তানির যথাক্রমে ৩২.৭ ও ১৬.৮ শতাংশ করা হয়েছে। সে তুলনায়, ২০২১ সালে রাশিয়ার মোট রপ্তানির মাত্র ১৪.৬ শতাংশ কিনেছিল চীন। ভারত আমদানি করেছিল মাত্র ১.৫৬ শতাংশ।
বাণিজ্যকে গতিশীল রেখে— পশ্চিমা রণবিদদের তাক লাগিয়ে রাশিয়া ন্যাটোভুক্ত সব দেশের মোট অস্ত্র উৎপাদনের চেয়ে বেশি করেছে। মস্কো অস্ত্রের উৎপাদন ১০ গুণ বেশি করেছে, কামানের গোলার ক্ষেত্রে তা ৭ গুণ বেশি। এ তথ্য দিয়েছে খোদ ন্যাটোভুক্ত দেশ এস্তোনিয়ার সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা। ভারত, চীন, তুরস্কসহ মধ্য এশিয়ার সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোও রাশিয়াতে তাদের রপ্তানি বহুগুণে বাড়ায়। মস্কোর ওপর দেওয়া আর্থিক নিষেধাজ্ঞাকে এড়াতে এই বাণিজ্যের জন্য তারা স্থানীয় মুদ্রাকে বেঁছে নেয়।
ফলে মার্কিন পররাষ্ট্র বলয়ের এস্টাব্লিশমেন্ট আর বলতে পারছে না যে, রুশ অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। তবে এখনও তারা মাঠপর্যায়ের যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে মিথ্যাচার করছে।
ইউক্রেন সেকারণেই হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করছে না, অন্যদিকে পশ্চিমা গণমাধ্যম ভর্তি শুধু রুশ হতাহতদের অতিরঞ্জিত সংখ্যাতে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দারা অনুমান করছেন, রাশিয়ার চেয়ে অনেক বেশি সেনা আহত ও নিহত হয়েছে ইউক্রেনের। এজন্যই ইউক্রেনের ৬৩ লাখ মানুষ এখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত, সামরিক বাহিনীতে ভর্তি এড়াতে সাড়ে ৬ লাখ ইউক্রেনীয় পুরুষ দেশে ছেড়ে পালিয়েছেন বলেও জানা গেছে। এই সংখ্যা এখন হয়তো আরও বেশি।
পশ্চিমা গণমাধ্যম দাবি করছে 'হিউম্যান ওয়েভ' আক্রমণ কৌশল গ্রহণ করায় বিপুল সংখ্যায় হতাহত হচ্ছে রুশ সেনারা। কিন্তু, এটি পুরোপুরি বানোয়াট। বরং রাশিয়া ছোট ছোট এক ডজনের মতো সেনাদল দিয়ে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করছে। হাজার হাজার সেনাকে একত্র করে তাঁরা একযোগে এভাবে আত্মঘাতী আক্রমণ করছে না, যেখানে অবধারিতভাবে প্রচুর সেনা নিহত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা গত জানুয়ারিতে যার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, প্ল্যাটুন (অন্তত ২০-২২ জন) আকারের চেয়ে বড় সেনা ইউনিট দিয়ে আক্রমণের নজির তেমন দেখা যায়নি। প্রতিদিন গড়ে রাশিয়া ১৫০-২০০টি এ ধরনের আক্রমণ পরিচালনা করছে। প্রতিটি আক্রমণের ক্ষেত্রে এক বা দুই স্কোয়াড সেনা অংশগ্রহণ করছে, যেখানে প্রতি স্কোয়াডে থাকছে ৭-১০ জন সেনা। এভাবে তারা ছোট ছোট দলে ইউক্রেনীয় অবস্থানগুলোর দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এসব স্কোয়াডও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আক্রমণ করে, তবে তাঁরা একইসাথে কোনো জায়গায় হামলা চালায়। যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখসারিতে আক্রমণকারী সেনারা প্রথমে সাঁজোয়া যানে চেপে আসে। এরপর পায়ে হেঁটে অগ্রসর হয়।
স্কোয়াডগুলো আবার তিন বা চারটি ফায়ার টিমে বিভক্ত হয়ে সামনে এগোয়। এভাবে যতদূর সম্ভব সামনে যেতে যেতে তারা ইউক্রেনীয় সেনাদের খোঁজে। শত্রু সেনাদের সন্ধান পাওয়া মাত্র তারা নিজেদের বহন করা অস্ত্র বা ড্রোন দিয়ে ইউক্রেনীয়দের ওপর হামলা করে। কখনোবা গোলন্দাজ বাহিনী বা বিমান বাহিনীকে তথ্য পাঠায়, যাতে ওই অবস্থানের ওপর কামান বা বিমানের হামলা হয়।
এভাবে বাঙ্কার, পরিখা বা ভবনে অবস্থানরত শত্রু সেনারা সবাই মারা না পড়া পর্যন্ত হামলা অব্যাহত থাকে। শত্রু নিহত হয়েছে এবিষয়ে নিশ্চিত হলেই আবার সামনে এগোয় রুশ সেনারা।
এই ধরনের কৌশলে নতুন ভূমি দখলের চেয়ে ইউক্রেনীয় সেনাদের হত্যা করাকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই ফাঁদ থেকে ইউক্রেন বেরোতে পারবে না বলেও মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে রাশিয়া এখন হতাহতের সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করছে। রাশিয়ান ওয়েবসাইটগুলো ঘেঁটে নিহতদের তথ্য যাচাইকারী মিডিয়াজোন জানাচ্ছে, ২০২৪ সালের শেষে ৮৭ হাজারের কম রুশ সেনা নিহত হয়েছে। এটা সর্বোচ্চ ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এরমধ্যে গত ১০০ দিনে নিহত হয়েছে ১৭ হাজার। যখন রাশিয়া তার নতুন আক্রমণ অভিযানে নামে।
অন্যদিকে ইউক্রেনের সেনাসদর দাবি করছে, প্রতি মাসে নাকি ৪০ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছে। এই দাবির কোনো ব্যাখ্যা তাঁরা কখনো দেয়নি। এতে দেখা যায়, প্রতিপক্ষের নিহতের সংখ্যা অন্তত ১০০ ভাগ বাড়িয়ে বলছে তারা।
পশ্চিমা একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার মতে, এই সময়ে ইউক্রেনের অন্তত ১ লাখ ৮ হাজার সেনা নিহত, এবং ৩ লাখ ৭৫ হাজার সেনা আহৎ হয়েছে। তবে নিহতের সংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজার নিহত এবং আহত ৬ লাখ ৪০ হাজার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালানো ইউক্রেনীয় সেনাদের সংখ্যাও প্রচুর। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত এক লাখ ইউক্রেনীয় সেনার বিরুদ্ধে পালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।
সর্বোপরি রাশিয়াও এই যুদ্ধের জন্য বিপুল মূল্য দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ইউক্রেনের মতো ভয়াবহভাবে নয়। সার্বিকভাবে রাশিয়ার জনসংখ্যাও ইউক্রেনের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বা প্রায় ১৫ কোটি। ফলে শক্তিক্ষয়ের এই যুদ্ধে ইউক্রেন কীভাবেই বা টিকতে পারত?
পশ্চিমা প্ররোচণার ফাঁদে পড়ে ইউক্রেন আজ একুল-ওকূল দুইই হারাচ্ছে। যুদ্ধের আগুনে পুড়েছে দেশ। জনগণও আর যুদ্ধ চাইছে না। এই অবস্থায়, পশ্চিমা বিশ্বের নব্য-রক্ষণশীলরা (নিউ-কনজার্ভেটিভ বা নিওকন) আক্রোশে, ক্ষোভে ফেটে পড়ছে ট্রাম্পের ওপর। যেন তিনিই এসবের জন্য দায়ী।
ইউক্রেন ও তার ন্যাটো মিত্ররাই যুদ্ধের আগুন উস্কে দেয়, ট্রাম্প কথাটি ঠিকই বলেছেন। যে যুদ্ধ কখনো শুরু করা উচিৎ ছিল না, তারা কেবল সেই যুদ্ধকেই উস্কে দেয়নি, বরং যুদ্ধ পরিচালনাতেও ব্যর্থ হয়েছে, ভুল করেছে নতুন সামরিক প্রযুক্তি রপ্ত করার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সক্ষমতাকে। ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞায় রুশ অর্থনীতির দমবন্ধ হয়ে যাবে– এই ধারণাও ছিল তাদের বিশাল ভুল। সুতরাং যুদ্ধপন্থী শিবির তাদের অপমান ও কর্মহীনতা ঠেকাতে সোচ্চার হবেই, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে নিজ সামর্থ্যের মধ্যে সবই করবে।