ইউরোপে জব্দ ৩০০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেন পুনর্গঠনে ব্যবহারে রাজি হতে পারে রাশিয়া: সূত্রের দাবি

ইউরোপে জব্দ হওয়া ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রুশ সম্পদ ইউক্রেন পুনর্গঠনে ব্যবহারের জন্য রাজি হতে পারে রাশিয়ার। তবে দেশটির বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনের এক-পঞ্চমাংশ এলাকার জন্যও এই অর্থের একটি অংশ ব্যয়ের শর্ত দিতে পারে মস্কো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিনটি সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে এসব তথ্য জানিয়েছে।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবে ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানে প্রথম সরাসরি বৈঠকে বসে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। এছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উভয়েই শিগগিরই সাক্ষাৎ করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন।
২০২২ সালে পুতিন ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে লেনদেন নিষিদ্ধ করে। এর ফলে ইউরোপীয়, মার্কিন ও ব্রিটিশ সরকারি বন্ডসহ রাশিয়ার ৩০০-৩৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ জব্দ করা হয়।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে মস্কো সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়া ইউরোপে তার জব্দকৃত সম্পদের একটি বড় অংশ ইউক্রেন পুনর্গঠনে ব্যবহারের প্রস্তাব দিতে পারে বলে তিনটি সূত্র জানিয়েছে।
পূর্ব ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। উভয় পক্ষের লক্ষাধিক সৈন্য হতাহত হয়েছে এবং শত শত ইউক্রেনীয় শরণার্থী হিসেবে ইউরোপ ও রাশিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক বছর আগের হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেন পুনর্গঠন ও পুনরুদ্ধারে ৪৮৬ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
তবে ক্রেমলিন এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
অন্যদিকে, ট্রাম্প ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের মাধ্যমে ওয়াশিংটনের দেওয়া সহায়তার প্রতিদান চান।
যুদ্ধবিরতির জন্য রাশিয়ার প্রধান দাবি হলো—কিয়েভের সেনারা তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে সরে যাবে এবং ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদ গ্রহণের প্রচেষ্টা বন্ধ করবে। অন্যদিকে, ইউক্রেন রাশিয়ার দখলকৃত এলাকা থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের এসব দাবি 'অবাস্তব' বলে উল্লেখ করেছে।
সৌদি আরবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের বৈঠকে জব্দকৃত সম্পদ ব্যবহারের প্রস্তাব আলোচিত হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জি-৭ এর ঘোষণা অনুযায়ী, ইউক্রেনকে ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় তহবিল জব্দ রাখা হবে। তবে ট্রাম্প রাশিয়াকে ধনী দেশগুলোর জোট জি-৭-এ ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দিয়েছেন।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার বা রিজার্ভ মুক্ত করার বিষয়ে তারা কোনো আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন না।
এর আগে রাশিয়া বলেছিল, জব্দ অর্থ ইউক্রেনে ব্যবহারের পরিকল্পনা 'ডাকাতি'র শামিল।
ইউক্রেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউস এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরও মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের মুখপাত্র আনিটা হিপার বলেছেন, 'ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত ইউক্রেন ও ইইউ'র অংশগ্রহণ ছাড়া নেওয়া যাবে না।'
তিনি আরও জানান, ইইউ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো যেকোনো আলোচনার আগে ইউক্রেনকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে সহায়তা করছে নতুন করছে। যেমন- রাশিয়ার ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে তারা।
রেনেসাঁ ক্যাপিটালের প্রধান বিশ্লেষক ওলেগ কুজমিন মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে সম্পদের ওপর থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠবে।
তার মতে, এটি কার্যকর করতে ইউরোপকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অবস্থানকে পূর্ণ সমর্থন দিতে হবে।
রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ পশ্চিমা দেশগুলোতে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছেন, 'প্রত্যর্পণ ঋণ' পদ্ধতিতে এই অর্থ ইউক্রেনকে হস্তান্তর করা হোক।
মস্কোর আলোচনার বিষয়ে জানেন—এমন এক সূত্রের মতে, শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে রাশিয়া জব্দ তহবিলের দুই-তৃতীয়াংশ ইউক্রেন পুনর্গঠনের জন্য ব্যবহারে সম্মত হতে পারে। তবে এর জন্য স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
অবশিষ্ট অর্থ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ইউক্রেনের অঞ্চলে ব্যয়ের দাবি জানাতে পারে রাশিয়া। কারণ এ অংশটিকে এখন তার নিজের ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে মস্কো।
আরেকটি সূত্র জানিয়েছে, মস্কো ইউক্রেন পুনর্গঠনে জব্দকৃত অর্থ ব্যবহারে সম্মত হতে পারে। তবে কীভাবে এ অর্থ বণ্টন করা হবে, তা নির্ধারণের সময় এখনx আসেনি।
অন্য দুটি সূত্রের মতে, পুনর্গঠনের ভবিষ্যৎ প্রকল্পগুলো কোন কোম্পানির হাতে যাবে, সে বিষয়টিও আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
এদিকে, আলোচনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়, তবে ক্রেমলিনের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া এখনx জব্দকৃত সম্পদ অবমুক্ত করার দাবি জানাবে। নিষেধাজ্ঞা ধাপে ধাপে শিথিল করার অংশ হিসেবে এটি বিবেচিত হবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা—বিশেষ করে জার্মান সরকার ও ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা—রাষ্ট্রীয় রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তাদের মতে, এটি আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে এবং ইউরোকে বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে দুর্বল করতে পারে।
রুশ কর্মকর্তারা বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা মুক্তবাজার অর্থনীতির নীতির পরিপন্থী। এটি ব্যাংকিং নিরাপত্তাকে নষ্ট করে এবং রিজার্ভ মুদ্রার প্রতি আস্থা কমিয়ে দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া এমন একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে, যাতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলোর কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীদের তহবিল বাজেয়াপ্ত করার অনুমতি দেওয়া হবে। তবে স্টেট দুমায় এখনো এই বিলের ওপর ভোট হয়নি।
রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জব্দকৃত সম্পদের মধ্যে ২০৭ বিলিয়ন ডলার ছিল ইউরোতে, ৬৭ বিলিয়ন ডলার মার্কিন ডলারে এবং ৩৭ বিলিয়ন ডলার ব্রিটিশ পাউন্ডে।
এছাড়া, ৩৬ বিলিয়ন ডলার জাপানি ইয়েন, ১৯ বিলিয়ন ডলার কানাডিয় ডলার, ৬ বিলিয়ন ডলার অস্ট্রেলিয় ডলার এবং ১.৮ বিলিয়ন ডলার সিঙ্গাপুরিয় ডলারে সংরক্ষিত ছিল। সুইস ফ্রাঁতে ছিল প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
জব্দকৃত সম্পদসহ রাশিয়ার মোট স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আনুমানিক ৬২৭ বিলিয়ন ডলার। তবে এসব সম্পদের মূল্য বন্ডের বাজারদর ও মুদ্রার বিনিময় হার অনুযায়ী ওঠানামা করে।
রাশিয়ার সর্ববৃহৎ বন্ড হোল্ডিং ছিল চীন, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া ও কানাডার রাষ্ট্রীয় বন্ডে। তবে রাশিয়ার স্বর্ণের রিজার্ভ নিজ দেশের মধ্যেই সংরক্ষিত ছিল।
২০২৪ সালের শুরুতে, বেলজিয়ামের ক্লিয়ারিং হাউজ ইউরোক্লিয়ার ব্যাংক প্রায় ১৫৯ বিলিয়ন ইউরো মূল্যের রুশ সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ছিল।
রাশিয়ার জব্দকৃত সম্পদ নিয়ে মস্কো ক্ষুব্ধ হলেও, দেশটির কট্টরপন্থী যুদ্ধপন্থী গোষ্ঠীর কেউ কেউ স্বীকার করেছেন যে, শেষ পর্যন্ত রাশিয়া এই সম্পদ ছাড়তে রাজি হতে পারে। তবে শর্ত হলো—রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলো মস্কোর অধীনেই থাকতে হবে।
২০২৩ সালে, রুশ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম আরটি-এর প্রধান মার্গারিটা সিমোনিয়ান বলেছিলেন, 'আমি একটি সমাধান প্রস্তাব করছি। এই অর্থ পশ্চিমাদের আমাদের দিতে হবে, যাতে যারা আমাদের সঙ্গে থাকতে চায়, আমরা সেই অঞ্চলগুলো কিনতে পারি।'
বর্তমানে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো দেশটির মোট জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ অবদান রাখে।
তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, যুদ্ধের পর যদি এসব অঞ্চল রাশিয়ার অংশ হিসেবে থেকে যায়, তাহলে তাদের অর্থনৈতিক অবদান দ্রুত বাড়তে পারে। ইতোমধ্যে এসব অঞ্চল থেকে রাশিয়ার মোট শস্য উৎপাদনের প্রায় ৫ শতাংশ আসে।