দ্য থ্রেড স্টোরি: স্বল্প দামে যেখানে ভাড়া পাবেন লাখ টাকার পোশাক!

ফ্যাশন কি কেবল নতুন পোশাকের প্রদর্শনী? নাকি পোশাকের মাধ্যমে গল্প বলা এবং নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দেওয়া? অনেকেই নির্দ্বিধায় দ্বিতীয় উত্তরটি বেছে নেবেন। সময়ের পরিবর্তন হোক বা অর্থনৈতিক বাস্তবতা—ফ্যাশন এখন শুধু বাহ্যিক সাজ নয়, বরং নতুন অভিজ্ঞতা এবং জীবনধারার অংশ। আর সেই অভিজ্ঞতা পেতে অনেকেই এখন নতুন পোশাক কেনার পরিবর্তে ঝুঁকছেন রেন্টাল ফ্যাশন, অর্থাৎ পোশাক ভাড়ার দিকে। সাশ্রয়ী তো বটেই, টেকসই ফ্যাশনের উত্থানেও এর জুড়ি মেলা ভার।
এই যেমন বেসরকারি চাকরিজীবী তানিয়ার কথাই ধরা যাক। প্রিয় বন্ধুর বিয়ে উপলক্ষে অনেকদিন ধরেই ভেবে রেখেছেন লেহেঙ্গা পরবেন। কিন্তু কিনতে গিয়ে বুঝলেন, ভালো মানের লেহেঙ্গা তার বাজেটের বাইরে। তাহলে কি বন্ধুর বিয়েতে তানিয়া নিজের মনমতো সাজবেন না? তানিয়ার মতো অনেকেই আছেন যারা একবার পরার জন্য দামি পোশাক কিনতে ইতস্তত বোধ করেন। আর করবেনই না বা কেন, গোটা বিশ্ব যখন পরিবেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে টেকসই ফ্যাশনের দিকে ঝুঁকছে, সেখানে একবার পরে পোশাক রেখে দেওয়া খানিকটা বিলাসিতাই বটে! আর তাদের জন্যই বাংলাদেশে চালু হয়েছে বাহারি পোশাক ভাড়া দেওয়ার প্ল্যাটফর্ম—দ্য থ্রেড স্টোরি। যেখানে নানান ব্র্যান্ডের লাখ টাকার পোশাক মিলবে মূল পোশাকের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ দামে।

বিশ্বজুড়ে রেন্টাল ফ্যাশন, অর্থাৎ পোশাক ভাড়া কোনো নতুন ধারণা নয়। এর প্রচলন শুরু হয় ২০ শতকের শুরুতে, যখন বিয়ের পোশাক ও টাক্সেডো ভাড়ার সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। একবার পরার জন্য ব্যয়বহুল পোশাক কেনার সামর্থ্য যাদের ছিল না, তারা রেন্টাল পরিষেবার মাধ্যমে সেই চাহিদা পূরণ করতেন। বিশেষত ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকে রেন্টাল ফ্যাশনের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ওঠে। অর্থনৈতিক মন্দা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সংকট মানুষকে ব্যয়বহুল পোশাকের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য করে। একবার পরার জন্য কেনার বদলে ভাড়ায় পোশাক নেওয়া হয়ে ওঠে কার্যকর ও সাশ্রয়ী সমাধান।
এরপর ১৯৬০-এর দশকে হ্যালোইন পার্টি, থিয়েটার শো এবং থিম পার্টির জনপ্রিয়তার কারণে পোশাক ভাড়ার ব্যবসা প্রসার লাভ করে। ২০০০-এর দশকে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা রেন্টাল ফ্যাশনের ধারা বদলে দেয়। বিশেষ করে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত রেন্ট দ্য রানওয়ে রেন্টাল ফ্যাশনকে সহজ ও জনপ্রিয় করে তোলে। সে সময় অনলাইনে কয়েকটি ক্লিকের মাধ্যমে মানুষ সহজেই নামী ডিজাইনারদের পোশাক ভাড়া নিতে পারত।

এর জন্য আজ পোশাক ভাড়া শুধু অর্থ সাশ্রয়ের একটি উপায় নয়—এটি একটি জীবনধারার রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে রেন্টাল ফ্যাশন তথা পোশাক ভাড়া দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিয়ে, গায়ে হলুদ, জন্মদিন, কর্পোরেট পার্টিসহ বিভিন্ন উৎসবে অনেকেই বেছে নিচ্ছেন এই ধারাটিকে। আর এই ধারণা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে দ্য থ্রেড স্টোরি-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো।
যেভাবে শুরু হলো
২০২০ সালে দ্য থ্রেড স্টোরি-র যাত্রা শুরু হয় আলিশা আলম এবং সুমনা শারমিনের হাত ধরে। প্রথমদিকে অনলাইনে কার্যক্রম চালালেও ২০২৪ সাল থেকে আউটলেটের মাধ্যমে পোশাক ভাড়া দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন তারা। নতুন আউটলেট গ্রাহকদের জন্য নিয়ে আসে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা, যেখানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাক হাতে ধরে দেখার এবং পছন্দ করে ভাড়া নেওয়ার সুযোগ মেলে।

আলিশা বলেন, 'বাংলাদেশে কিন্তু অনেক রেন্টাল প্ল্যাটফর্ম আছে, কিন্তু রেন্টাল ব্র্যান্ড নেই। অর্থাৎ রেন্ট নিয়েও যে ব্র্যান্ড তৈরি করা যায়, সেই চিন্তাধারা থেকেই আমাদের শুরু করা। এলিফ্যান্ট রোডের কথা যদি বলি, সেখানে অনেক বছর ধরেই ছেলেদের বিয়ের পোশাক ভাড়া পাওয়া যায়। কিন্তু মেয়েদের জন্য নির্ধারিত এমন কোনো ব্র্যান্ড ছিলো না। ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের তৈরি করার জন্যই যাত্রা শুরু।'
বিয়েতে বর-কনের বোন বা বন্ধু, অর্থাৎ ব্রাইডমেইডদের জন্য পোশাকই দ্য থ্রেড স্টোরির অন্যতম আকর্ষণ। প্রতিষ্ঠানটির সহপ্রতিষ্ঠাতা আলিশা আলম বলেন, 'বিয়ের জন্য অনেকেই দামি শাড়ি, লেহেঙ্গা বা গয়না কেনেন। কিন্তু ব্রাইডমেইডরা সাধারণত এত টাকা খরচ করতে চান না। সেই চিন্তা থেকেই আমরা ব্রাইডমেইডদের জন্য বিশেষভাবে ফোকাস করেছি।' এখানে শুধু পছন্দসই পোশাকই নয়, গ্রাহকরা পোশাকের সাথে মানানসই গয়না, জুতা ও ব্যাগও ভাড়া নিতে পারবেন।

বাহারি ব্র্যান্ডের সমাহার
দ্য থ্রেড স্টোরিতে পাওয়া যায় ব্রাইডাল, নন-ব্রাইডাল, গাউন, পার্টিওয়্যার, শাড়ি, কামিজসহ নানা ধরনের পোশাক। এর মধ্যে গ্রাহকদের মধ্যে লেহেঙ্গা ও গাউনের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। বিজনেস ডেভেলপমেন্ট টিমের সদস্য মিরাজ বলেন, 'আমাদের মূল টার্গেটেড কাস্টমার হলো ব্রাইডমেইড এবং তাদের বন্ধুরা।' এছাড়াও কর্পোরেট ইভেন্ট, বিশেষ করে গালা নাইটের অতিথিরাও এখান থেকে পোশাক ভাড়া নেন।
নিবিড় ফ্যাশন, আনজারা, খান ব্রাদার্স, আড়ং, খুঁত প্রভৃতি ব্র্যান্ডের লেহেঙ্গা ও শাড়ি পাওয়া যায় দ্য থ্রেড স্টোরি-তে। তাছাড়া নিজস্ব কারিগরের তৈরি পোশাকও তাদের ভান্ডারে আছে। বড় বড় ব্র্যান্ডের পোশাক যাতে অল্প খরচেই গ্রাহক পরতে পারে, তার জন্যই চালু হয়েছে এই উদ্যোগ।

এখানে ভাড়াকৃত ব্রাইডাল পোশাকের দাম শুরু ২ হাজার টাকা থেকে। এছাড়া ৫০০ টাকা থেকেই শাড়ি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ আছে। এই দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে পোশাকের পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক খরচ। দ্য থ্রেড স্টোরির বিজনেস ডেভেলপ টিমের আরেক সদস্য আনিকা বলেন, 'আমাদের এখানে সব ক্যাটাগরির পোশাক পাওয়া যায়। স্ট্যান্ডার্ড পোশাকও আছে, প্ল্যাটিনাম ক্যাটাগরির পোশাকও আছে, আবার এক্সক্লুসিভ কালেকশনও আছে। এক লাখ টাকার লেহেঙ্গাও আছে, আবার ২০ হাজার টাকার লেহেঙ্গাও আছে।'
পোশাক ভাড়ার পদ্ধতি
৩ থেকে ৫ দিনের জন্য পোশাক ভাড়া পাওয়া যায় দ্য থ্রেড স্টোরিতে। কমপক্ষে তিনদিন আগে পোশাক ভাড়া নিতে হয়। তবে প্রি-বুকিংয়ের সুযোগও আছে। কেউ চাইলে এক থেকে দেড় মাস আগেও পোশাক ভাড়ার জন্য নির্ধারণ করে যেতে পারবেন। এর জন্য প্রয়োজন ভাড়াকৃত পোশাকের মূল্যের ৫০ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধ। এর পাশাপাশি যিনি ভাড়া নিচ্ছেন, তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি এবং একজন জামিনদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি। এরপর যখন পোশাক প্রয়োজন, তখন ব্যক্তি নিজে পোশাক সংগ্রহ করতে পারবেন, নয়তো কর্তৃপক্ষ মারফত পোশাক ডেলিভারি নিতে পারেন। তবে পোশাক গ্রহণের সময় অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হবে।

পোশাক যদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেক্ষেত্রে ক্ষতি হওয়া বাবদ খরচ কর্তৃপক্ষ গ্রাহকদের কাছ থেকে নিয়ে থাকেন। 'যদি এমন হয় যে কোনো পোশাক ছিঁড়ে গেছে, এবং এমনভাবে ছিঁড়েছে যে কখনো ব্যবহার করা যাবে না, তখন প্রোডাক্টের ৫০ শতাংশ চার্জ আমরা নিয়ে থাকি। বাকিটা আমরা বহন করি। আবার যদি রিপু করলেই পোশাক ঠিক হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে শুধু সেই খরচটি আমরা নিই। পোশাকের মূল দামের ১০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ আমরা ভাড়ার জন্য নিই। এরমধ্যে যুক্ত থাকে ওয়াশ করার খরচ, অলটার করার খরচ। সবমিলিয়ে দাম নির্ধারিত হয়,' বলেন আলিশা।
তবে কেউ যদি পোশাক ৫ দিনের বেশি রাখেন, তবে তাকে গুণতে হবে জরিমানা। তবে সেই জরিমানা পোশাকের দামের ওপরেই নির্ধারিত হবে।
প্রত্যেক পোশাকের নিজস্ব কিছু জীবনকাল থাকে। দ্য থ্রেড স্টোরিতে এই বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। ১০ থেকে ১৫ বারের বেশি কোনো পোশাক ভাড়ার জন্য দেওয়া হয় না। প্রতি মাসে একেকটি পোশাক ৩ থেকে ৪ বারের মতো ভাড়া দেওয়া হয় এখানে। পোশাক ফেরত আসার পর ২ দিনের জন্য ওয়াশে দেওয়া হয়। ড্রাই ক্লিন করে এরপর অন্য গ্রাহককে পোশাক দেওয়া হয়।

আছে বিনিয়োগের সুযোগ!
দ্য থ্রেড স্টোরিতে রয়েছে বিনিয়োগের সুযোগ। এখানে যদি কেউ ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন, তবে বছর শেষে পাবেন অতিরিক্ত ৩ হাজার ৬০০ টাকা। তাছাড়া বিনিয়োগকারী দ্য থ্রেড স্টোরি এবং এর সাথে যুক্ত অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম উদ্যোগ থেকেও পাবেন ছাড়ের সুযোগ।
প্রতিষ্ঠানের সদস্য শোভা বলেন, 'দশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করলে বছর শেষে পাওয়া যাবে ১৩ হাজার ৬০০ টাকা। অনেকে ১৩ হাজার ৬০০ টাকাসহ বিনিয়োগ করে দেন আমাদের কাছে। দেখা যাবে দশ হাজার টাকা থেকে ৩০-৪০ হাজার টাকা হয়ে গেছে দুই-তিন বছরে। আমরা দশ হাজার টাকার বিনিময়ে প্রতি মাসে ১ শতাংশ প্রফিট দেই, অর্থাৎ ১০০ টাকা পাওয়ার সুযোগ আছে প্রতি মাসে। ছয় মাস পরপর ১০০ টাকার বাইরে অতিরিক্ত ১ হাজার ২০০ টাকা করে আমরা দেই। সবমিলিয়ে বছর শেষে ৩ হাজার ৬০০ টাকা পাওয়া যাবে। কেউ যদি চান, তাহলে মাস শেষে লাভের টাকা তুলে নিতে পারবেন, আবার একবারে বছর শেষেও পারবেন।'
দ্য থ্রেড স্টোরির স্বত্বাধিকারী আলিশা আলম মনে করেন, ফ্যাশন ব্যবসায় ট্রেন্ড ফলো করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে সিজনাল ট্রেন্ড বেশি থাকায় ফ্যাশন ট্রেন্ড দ্রুত পরিবর্তিত হয়, যা ব্যবসায় তাল মেলানো কঠিন করে তোলে।

এছাড়াও ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট একটি বড় সমস্যা। আলিশা বলেন, 'একটি ড্রেস ডাবল বুকিং হয়ে গেলে কেউই মেনে নিতে চান না যে সেটি অন্য কারও কাছে বুক হয়ে গেছে। এই সমস্যা সমাধানে আমরা সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছি। আশা করি, খুব শিগগিরই এটি ওভারকাম করতে পারব।'
বর্তমানে ১০ জন কাজ করেন দ্য থ্রেড স্টোরিতে। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত খোলা থাকে প্রতিষ্ঠানটির শো-রুম। ধানমণ্ডির ৩ নং রোডের ২৩ নম্বর বাড়িতে দেখা মিলবে পোশাক ভাড়া নেওয়ার রঙিন ভান্ডারটির। কিছুটা স্থানাভাবের জন্য প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩০ জন গ্রাহক ঘুরে যেতে পারেন এখানে। তবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আউটলেটে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন স্বত্বাধিকারী। তিনি বলেন, 'আমরা প্রতি ঘণ্টায় ৫ জন করে নিচ্ছি। একজন ক্লায়েন্টকে কমপক্ষে ৩০ মিনিট করে সময় দিতে হয়। এজন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট সিস্টেম করা। ওয়েবসাইট থেকে এপয়েন্টমেন্ট নিলে সেখানেই স্লট টাইম দেখাবে।'

পোশাক ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি মেকাপ, ফটোগ্রাফিসহ ওয়ানস্টপ সলিউশন নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখে দ্য থ্রেড স্টোরি। এক ছাদের তলাতে বসেই যাতে গ্রাহক সব সুবিধা পেতে পারেন, সেই লক্ষ্যেই কাজ করে চলেছেন তারা।