ভারতবর্ষের পায়জামা যেভাবে পশ্চিমা পায়জামা হয়ে উঠল

পশ্চিমা বিশ্বে পায়জামা মূলত একটি আরামদায়ক পোশাক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর ক্ষেত্রে কিংবা বাড়িতে অবসরের মুহূর্ত কাটানোর সময় পোশাকটি বেশি ব্যবহৃত হয়।
পায়জামার উৎপত্তি মূলত এশিয়ায়। এ অঞ্চলের লোকেরা সচরাচর ঘরের বাইরে কোথাও গেলে এটি পরে থাকেন।
প্রায় তিন হাজার বছর আগে চীনের পশ্চিমাঞ্চলের যাযাবর অশ্বারোহীরা কোমরে বাঁধা ঢিলেঢালা প্যান্ট পরা শুরু করেন, যা তাদের ব্যবহৃত এক খণ্ডবিশিষ্ট পোশাক বা টিউনিকের চেয়ে বেশি আরামদায়ক ছিল। পরে পারস্যের লোকেদের গায়েও এ পোশাক দেখা যায়। তাদের মাধ্যমে ধীরে ধীরে পোশাকটি এশিয়াজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারতবর্ষে পায়জামার সঙ্গে যুক্ত হয় কুর্তা (লম্বা, ঢিলেঢালা, কলারবিহীন শার্ট। যেটি আজও পুরুষ ও নারী উভয়ের কাছেই সমান জনপ্রিয়।
১৭শ ও ১৮শ শতকে ভারতে আসা ইউরোপীয়রা স্থানীয়দের কুর্তা পায়জামা পরতে দেখেন। তুলার তৈরি নরম কাপড় বা এশিয়ান সিল্কের এই পোশাক ইউরোপের তৎকালীন আঁটসাঁট কাপড়ের তুলনায় অনেক বেশি আরামদায়ক ছিল। তবে সে সময় এটি কেবল ইউরোপের অভিজাত শ্রেণির লোকেদের পোশাক ছিল। অনেকে এশিয়া সফর শেষে সেগুলো সংগ্রহ করে রাজদরবারে প্রদর্শন করতেন।
ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি উইলিয়াম ফিল্ডিং ১৬৩১ সালে পারস্যের শাহ প্রথম সুফি ও ভারতের মোগল সম্রাট শাহজাহানের দরবারে সফরকালে ভারতীয় কুর্তা পায়জামা সংগ্রহ করেন। পরে ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি এই পোশাক পরে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী অ্যান্থনি ভ্যান ডাইকের কাছ থেকে নিজের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে নেন। এর মধ্যে দিয়ে তিনি মানুষের সামনে দূর দেশ ও সেখানকার সংস্কৃতি সম্পর্কে তার জ্ঞান প্রদর্শন করতে চেয়েছিলেন। প্রতিকৃতিটিতে তার কুর্তা পায়জামার নিচে শার্টের কলার ও হাতার একটি অংশও দেখা যাচ্ছিল।

সেই সময়ে ইউরোপে সিল্ক অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও এশীয় ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল। প্রতিকৃতিটিতে ফিল্ডিংয়ের পাশে এক তরুণ ভৃত্যকেও দেখা যায়। তার পরনে ছিল বিলাসবহুল কুর্তা পায়জামা। আর মাথায় ছিল নকশাদার পাগড়ি।
১৮শ ও ১৯শ শতকে ভারতজুড়ে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয় পোশাকের জনপ্রিয়তা ইউরোপে আরও বাড়ে। ব্রিটিশরা বাড়িতে আরামদায়ক পোশাক হিসেবে 'বানিয়ান' পরা শুরু করেন। এটি অনেকটাই জাপানি কিমোনোর (আলখাল্লা জাতীয় পোশাক) মতো ছিল। অন্যদিকে ভারতে কর্মরত ব্রিটিশ কর্মকর্তারা উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কথা ভেবে আরামদায়ক পোশাক হিসেবে কুর্তা পায়জামা পরতে শুরু করেন।
সে সময় ইউরোপের সব শ্রেণির মানুষেরই রাতে ঘুমানোর জন্য লিনেন বা উলের তৈরি পোশাক পরার প্রচলন ছিল। ১৮শ ও ১৯শ শতকে 'নাইটশার্ট' বা 'নাইটগাউন' বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯শ শতকের শেষদিকে এসে ঘুমানোর পোশাক হিসেবে পায়জামা পরিধান করা শুরু হয়।
ভিক্টোরিয়ান যুগের উচ্চবিত্ত পুরুষেরা নাইটগাউনের পরিবর্তে পায়জামার বিকল্প হিসেবে ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক পোশাক পরতেন বলে মনে করা হয়। এটি ছিল ঢিলেঢালা একটি শার্ট ও একটি প্যান্ট। তবে ইউরোপীয় রুচির সঙ্গে মানানসই করতে কুর্তাকে শার্টের আকৃতি দেওয়া হয় এবং এতে কলার ও বোতাম যোগ করা হয়।

ব্রিটিশ প্রভাবের কারণে পায়জামার জনপ্রিয়তা আরও ছড়িয়ে পড়ে। শুরুতে এটি বিলাসবহুল পোশাক হিসেবে বিবেচিত হতো। সে সময় বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন দর্জিরা এটি তৈরি করতেন। তবে ১৯শ শতকের শেষদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পায়জামার ব্যাপক উৎপাদন শুরু হলে এটি সাধারণ মানুষের জন্যও সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
এরপর পায়জামা যুক্তরাষ্ট্রের দোকানগুলোতে স্বল্পমূল্যে বিক্রি হতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন সংস্কৃতির প্রভাবে এটি ইউরোপেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৩৩ সালে ফরাসি পুরুষদের ফ্যাশন ম্যাগাজিন এডাম কেমিসিয়ারে এক দীর্ঘ নিবন্ধে পায়জামার সুবিধা ও নাইটগাউনের অসুবিধার কথা তুলে ধরা হয়।
প্রথমদিকে পায়জামা কেবল পুরুষদের জন্যই বাজারজাত করা হযতো। নাইটগাউনের তুলনায় এটিকে বেশি পুরুষালি বিবেচনা করা হতো, যা এর দ্রুত জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। ২০শ শতকের প্রথমার্ধের সিনেমাগুলোও এই ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সাহায্য করে।

অন্যদিকে নারীরা দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী নাইটগাউনে সীমাবদ্ধ ছিলেন, কারণ তখনও দিনের পোশাক হিসেবে প্যান্ট পরার প্রচলন নারীদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল না। তবে ১৯২০-এর দশকে কর্সেট, লম্বা স্কার্ট ও বড় হ্যাটের পরিবর্তে আরামদায়ক ফ্যাশন জনপ্রিয় হতে শুরু করলে নারীদের পোশাকেও পায়জামার ব্যবহার দেখা যায়।
প্রথমদিকে এটি ঘরের বাইরের পোশাক হিসেবেও ব্যবহৃত হতো, বিশেষ করে গ্রীষ্মকালীন প্যান্টসুট বা 'বিচ পায়জামা' হিসেবে। কিংবদন্তি ফ্যাশন ডিজাইনার কোকো শ্যানেল ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা বিচ পায়জামা পরা ছবি তুললে এটি নতুন ট্রেন্ড হয়ে ওঠে। শ্যানেলের ডিজাইনগুলোতে সাধারণত উজ্জ্বল রঙের ঢিলেঢালা প্যান্টের সঙ্গে মানানসই টপ ব্যবহৃত হতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কাঁচামালের রেশনিংয়ের কারণে পায়জামার ডিজাইনে ব্যবহারিক দিককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে সময় তুলা ও উলের মিশ্রণে উষ্ণ ও আরামদায়ক কাপড় ব্যবহৃত হতো। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রক্ষণশীল পারিবারিক মূল্যবোধের কারণে নারীদের জন্য পায়জামাকে নাইটগাউনের তুলনায় বেশি শালীন পোশাক বলে বিবেচনা করা হতো।
ভারতে কুর্তা পায়জামার বিবর্তন এক অনন্য ধারা তৈরি করেছে। এটি ঐতিহ্য ও আধুনিক ফ্যাশনের মিশ্রণে রূপান্তরিত হয়েছে এবং গর্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। পশ্চিমা প্রভাবের ফলে পায়াজামা তৈরির কাপড় ও সেলাইয়েও বৈচিত্র্য এসেছে।
ভারতে পায়জামা আজও বাইরে পরিধানের জন্য অন্যতম জনপ্রিয় পোশাক। পাশাপাশি এটি বিবাহ বা উৎসবের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রধান পোশাক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
অনুবাদ: পনিচুজ্জামান সাচ্চু