এশিয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্যের ‘লিটমাস টেস্ট’ যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সংলাপ

সংলাপের মাধ্যমে ইউক্রেনে যুদ্ধের ইতি টানতে উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া; যার ব্যাপক প্রভাব শুধু ইউরোপে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এশিয়া মহাদেশকেও আন্দোলিত করবে এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের ঢেউ।
যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন সৌদি আরবে এই সংলাপের সূচনা করেছে, তখন এশিয়ায় চীন ও ভারতকে তাঁর কৌশল পুনর্বিবেচনা করতে হচ্ছে। দিল্লি ও বেইজিং উভয়েই এমন বোঝাপড়ার সম্ভাবনা ও ঝুঁকি – উভয় দিক নিয়েই সতর্ক।
চীন এই কূটনৈতিক বোঝাপড়াকে দেখবে তার নিজস্ব ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার দৃষ্টিকোণ দিয়ে। ইউক্রেন যুদ্ধের পুরোটা সময়েই – ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে বেইজিং – নিজেকে উপস্থাপন করেছে নিরপেক্ষ একটি পক্ষ হিসেবে; আবার একইসময়ে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যানেলে সমর্থন দিয়ে গেছে মস্কোকে।
যুদ্ধবিধবস্ত ইউক্রেনের দরকার পুনর্গঠন। শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগে দেশটিতে তার বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ (বিআরআই) সম্প্রসারণের চেষ্টা করতে পারে বেইজিং। এতে ইউরোপের ওপর চীনের প্রভাব আরও গভীর হবে, তবে তাতে ক্ষোভ জন্মাতে পারে মস্কোতে। যেকারণে রাশিয়ার সাথে মিত্রতার বন্ধন কতটা দৃঢ়– সেটিও হবে পরীক্ষিত।
যুদ্ধাবসানের পরে চীন তাইওয়ানের বিষয়ে তার অবস্থান পুনর্মূল্যায়নের সুযোগও পাবে, বিশেষত যদি যুক্তরাষ্ট্র আবারো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনে।
ট্রাম্প যদি ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি চুক্তির মধ্যস্ততা করতে আসলেই আন্তরিক হন; তাহলে দক্ষিণ চীন সাগর-সহ ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ঠেকাতে তিনি কতোটা দৃঢ় অবস্থান নেবেন— সে প্রশ্নও থাকবে।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বজায় রেখে, ভারত কূটনৈতিক নমনীয়তার একটি জটিল খেলা খেলেছে। যুদ্ধ-পরবর্তী একটি সমঝোতা নয়াদিল্লিকে তার জ্বালানি নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে।
কারণ, যুদ্ধের সময় ছাড়কৃত মূল্যে রাশিয়ান তেল কিনে সুবিধাভোগী হয় ভারত। দেশটির অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখতে সস্তার জ্বালানি বড় ভূমিকাও রাখে। ফলে নয়াদিল্লি অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে আশাব্যঞ্জক বার্তাই দিতে পেরেছে বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের। কিন্তু, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে যদি রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ফের স্বাভাবিক হয়— তাহলে কম দামে জ্বালানিসহ অন্যান্য পণ্যদ্রব্য কেনার সুযোগ আর পাবে না।
তবে স্থিতিশীল একটি আন্তর্জাতিক জ্বালানি বাজার – বাকি বিশ্বের মতো ভারতীয় অর্থনীতিতেও মূল্যস্ফীতির চাপ কমাবে; যা দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা পূরণের সহায়ক হবে।
এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের একনিষ্ঠ মিত্র– জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া, বাইডেন আমলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিল। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেয় তারা, আবার ইউক্রেনকে সহায়তাও প্রদান করে। এখন ওয়াশিংটন ও মস্কো যদি কূটনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছায় – তাহলে টোকিও আর সিউলকে আগের অবস্থান থেকে সরে আসার জটিল কাজটি করতে হবে।
পুতিনের সাথে সমঝোতার কারণে দূরপ্রাচ্য অঞ্চলের আঞ্চলিক নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় হবে না বা ছাড় দেবে না– এমন নিশ্চিয়তা ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে চাইবে জাপান ও দ. কোরিয়া। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং সমুদ্রসীমায় চীনের কর্তৃত্ববাদী আচরণ মোকাবিলা নিয়েই তাদের মূল উদ্বেগ।
তাছাড়া, রাশিয়ার কুরিল দ্বীপপুঞ্জ নিয়েও জাপানের সাথে ঐতিহাসিক বিরোধ আছে। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্কের বরফ গলার সুবাদে এই দ্বীপপুঞ্জ নিয়েও নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সংঘাতের অবসান বৈশ্বিক পণ্যদ্রব্যের বাজারের অস্থিতিশীলতাকে লাঘব করবে, যা এই যুদ্ধের শুরুর সময় থেকেই কমবেশি বিরাজ করছে।
এশিয়া মহাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম খাদ্য ও জ্বালানি আমদানিকারক। সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হওয়ার সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী তাই এশিয়াই হয়েছে। যেখানে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠিয়েছে। কিন্তু, যুদ্ধ বন্ধ হলে অনায়সে ইউক্রেন থেকে আসতে পারবে জাহাজ বোঝাই খাদ্যশস্যের চালান, এতে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, বাংলাদেশের মতো আমদানি-নির্ভর দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
ইউক্রেনের পুনর্গঠন শুরু হলে— এশিয়ার প্রতিরক্ষা ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের উৎপাদকরাও নতুন রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে পাবে দেশটিকে।
রাশিয়াকে ঠেকাতে ইউরোপে শুরু হয় সামরিক শক্তিবৃদ্ধির দৌড়, সেখানে রপ্তানির মাধ্যমে এরমধ্যেই লাভবান হয়েছে দ. কোরিয়া। তবে যুদ্ধ শেষ হলেও— রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় মিত্রদের হাত ছেড়ে দিচ্ছে, এমন মনোভাব আরও তীব্র হবে। ইউরোপের ন্যাটো সদস্যরা ওয়াশিংটনের ওপর এককভাবে নির্ভর না করে নিজস্ব সামরিক শক্তি বাড়াতে আরও উদ্যোগ নেবে, এই রণসজ্জা সিওলের সামনে আরও অস্ত্রচুক্তি লাভের সুযোগ তৈরি করবে।
ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার অর্থ অবশ্য সার্বিক বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সমঝোতায় যদি মস্কোকেই বেশি লাভবান মনে হয়— তাহলে এশিয়াতেও যেসব দেশ অন্যের ভূখণ্ড দখলে নিতে চায়, বা হারানো ভূখণ্ডের পুনরুদ্ধার চায় – তারা আরও সাহসী হবে।
এশিয়ায় চীনের সমুদ্রসীমার দাবি নিয়ে তার প্রতিবেশীদের উদ্বেগ আছে। ফলে এই ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির পরিণামের দিকে ঘনিষ্ঠভাবে নজর রাখবে তাইওয়ান, ভিয়েতনাম ও ফিলিপাইন। সম্ভাব্য ফলাফল তারা চুলচেরা বিশ্লেষণও করবে। এতে করে, প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পেশিশক্তি দুর্বল হতে পারে বলেই দেশগুলোর আশঙ্কা।
আঞ্চলিক ক্ষমতার গতিশীলতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে মার্কিন সরকার যদি যুক্তরাষ্ট্রের ঘরোয়া সমস্যা সমাধানেই বেশি মনোযোগ দেয় এবং ইউক্রেন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়— তাহলে মিত্র হিসেবে ওয়াশিংটনের নির্ভরযোগ্যতাও নতুন করে সমালোচনার মুখে পড়বে।
এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলি, যারা এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা গ্যারান্টির ওপর নির্ভর করেছে– আরও ঝুঁকে পড়বে চীনের দিকে। এসব দেশের আঞ্চলিক জোট আসিয়ান-ও চীনের সাথে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা আরও বাড়ানোর জন্য চাপ অনুভব করবে।
ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের মধ্য মেয়াদি প্রভাবে এশিয়ার আর্থিক ও পুঁজিবাজার ইতিবাচকভাবে সাড়া দিতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্যের স্বাভাবিকীকরণের হাত ধরে পুঁজিবাজারে চাঙ্গাভাব দেখার আশা রয়েছে।
ইউক্রেন থেকে শিল্পকাজে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানি ফের স্বাভাবিক হওয়া, এবং মস্কোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওঠার মাধ্যমে– জ্বালানি সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কাও দূর হলে— এশিয়ার প্রধান প্রধান বাজারগুলোয় গতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেখা পাওয়া যাবে। বর্তমানে যা তাদের অত্যন্ত দরকার।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর মূল্যে যদি এই শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়, তাহলে এশিয়ার বাজারগুলো খুব শিগগিরই বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে চলেছে — যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাধা না থাকায় আঞ্চলিক বৈরীতাগুলো ইচ্ছেমতো ডালপালার বিস্তার করতে পারে।
সুতরাং, ইউক্রেনের জন্য শান্তিচুক্তি কেবল ইউরোপের বিষয় নয়, এশিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্যও এটি এক 'লিটমাস টেস্ট'। যার আতসে পরিক্ষীত হবে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক জোটবদ্ধতা। ভূখণ্ডগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা দেশগুলোও কষবে নতুন কৌশলগত ছক।
ইউক্রেনে শান্তি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে আছে, তবে এশিয়ার জন্য আসল নাটকের মঞ্চায়ন সবে তো শুরু হয়েছে।
লেখক: জর্জ প্রিওর আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির একজন বিশ্লেষক ও মতামত কলাম লেখক।