নতুন প্রজন্মের, বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামরিক পরিবহন বিমান তৈরির পরিকল্পনা চীনের

আধুনিক সামরিক বাহিনীর মেরুদণ্ড হচ্ছে তার রসদ ও সেনা পরিবনের সক্ষমতা। প্রয়োজনমতো যেকোনো স্থানে এসব নিয়ে যেতে আকাশপথে পরিবহনই সবচেয়ে দ্রুত সমাধান। যুক্তরাষ্ট্র এদিক থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তবে পিছিয়ে থাকার পাত্র নয় চীন-ও। বর্তমানে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স (পিএলএএএফ)–এর জন্য নতুন প্রজন্মের একটি কৌশলগত পরিবহনবিমান তৈরির পরিকল্পনা চলছে, যা সম্পন্ন হলে দেশটির বিমানবাহিনীর লজিস্টিক সক্ষমতায় বিপ্লব ঘটতে পারে, নতুন এয়ারক্রাফটটি বেইজিংকে বিশ্বব্যাপী অপারেশন পরিচালনার ক্ষমতা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রযুক্তিগত গবেষণাপত্রে এ প্রকল্পের বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিমানের নকশায় "ব্লেন্ডেড উইং–বডি" কনফিগারেশন ব্যবহার করার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে—যেখানে বিমানের উভয় ডানা ও মূল কাঠামো একীভূত হয়ে একটি সম্পূর্ণ উত্তোলনক্ষম গঠন তৈরি করবে। ফলে অনেক দূরপাল্লার হবে এই উড়োজাহাজ, থাকবে অনেক কার্গো ধারণক্ষমতা। এই ধরনের নকশায় তৈরি বিমান জ্বালানি সাশ্রয়ীও হয়। এটি চীনের বর্তমান হেভি লিফটিং এয়ারক্রাফট মধ্যপাল্লার ওয়াই–২০ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। একইসঙ্গে বৈশ্বিক এভিয়েশন নকশার ক্ষেত্রেও এক নতুন দৃষ্টান্ত।
গবেষণাপত্রে আরও বলা হয়, প্রকল্পটির লক্ষ্য হলো উড়োজাহাজটির পাল্লা (রেঞ্জ) ও পণ্য বহনক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা, পাশাপাশি অপ্রস্তুত বা কাঁচা রানওয়ে থেকেও অপারেশন চালানোর সক্ষমতা বাড়ানো।
দীর্ঘ পাল্লা ও বিশাল বহনসক্ষমতা
পুরো কার্গো বোঝাই অবস্থায়ও নতুন বিমানটির সর্বোচ্চ ৬,৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জ থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এতে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে রিফুয়েলিং বা জ্বালানি ভরা ছাড়াই ফ্লাইট পরিচালনা সম্ভব হবে।

সে তুলনায়, ওয়াই–২০ এর পাল্লা ৪,৫০০ কিলোমিটার, যা ইতোমধ্যেই বিশ্বের দীর্ঘতমগুলোর একটি। অপরদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর সি–৫ গ্যালাক্সি —পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক পরিবহন বিমান—এর রেঞ্জ প্রায় ৪,১৫০ কিলোমিটার।
নতুন বিমানে ১২০ টন কার্গো বহনের সক্ষমতা থাকবে এবং সর্বোচ্চ টেকঅফ ওজন প্রায় ৪৭০ টন পর্যন্ত হবে। তুলনামূলকভাবে, ওয়াই–২০ বহন করতে পারে ৬৬ টন এবং এর টেকঅফ ওজন প্রায় ২৫০ টন।
অর্থাৎ নতুন বিমানটির যুক্তরাষ্ট্রের সি–৫ এর সমপর্যায়ের পণ্যবহন সক্ষমতা থাকবে, কিন্তু তার চেয়েও ৫০ শতাংশের বেশি রেঞ্জ থাকবে।
নতুন নকশা ও উন্নত ইঞ্জিন প্রযুক্তি
এত উচ্চ কর্মক্ষমতার মূল চাবিকাঠি হলো ব্লেন্ডেড উইং–বডি কাঠামো, যা শুধু বিমানের ভেতরের জায়গা বাড়ায় না, বরং অ্যারোডায়নামিক্সের দক্ষতাও বাড়ায়।
একই সঙ্গে এতে ব্যবহৃত হবে নতুন প্রজন্মের উন্নত ইঞ্জিন, যা বর্তমান পরিবহনবিমানে ব্যবহৃত ইঞ্জিনের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ও জ্বালানি–দক্ষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যেভাবে ওয়াই–২০ থেকে তৈরি হয়েছে ওয়াইওয়াই-২০ আকাশে জ্বালানি সরবরাহকারী বিমান এবং কেজে–৩০০০ আকাশ থেকে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, একইভাবে নতুন এই পরিবহন বিমানটি থেকেও ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিশেষায়িত ভ্যারিয়েন্টে তৈরি করা হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
এছাড়া চীন ইতোমধ্যেই যে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান এবং আন্তঃমহাদেশীয় রেঞ্জের কৌশলগত বোমারু বিমান এইচ–২০ এর উন্নয়ন করছে, তাও নতুন রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কারের চাহিদা বাড়াবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এর মাধ্যমে চীন তার সমুদ্রসীমা সংলগ্ন "সেকেন্ড আইল্যান্ড চেইন"–এরও বাইরে অপারেশন পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও কৌশলগত গুরুত্ব
চীনের এই নতুন প্রকল্প এমন সময় চলছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া—দুই দেশই তাদের পুরনো ভারী পরিবহন বিমান সি–৫ গ্যালাক্সি ও এএন–১২৪ এর উত্তরসূরির তৈরিতে কাজ করছে। এরমধ্যে সি–৫ গ্যালাক্সির উৎপাদন বন্ধ হয় ১৯৮৯ সালে, আর এএন–১২ এর ২০০৪ সালে। ফলে বর্তমানে চীনের ওয়াই–২০ উৎপাদনে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবহন বিমান।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিশ্বব্যাপী সামরিক ঘাঁটির নেটওয়ার্ক না থাকায়, চীনের ক্ষেত্রে এত বড় পরিবহন বিমানের ব্যবহারিক প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। একারণে চীন প্রকৃতপক্ষ কতগুলো এধরনের বিমান কিনতে পারে তাও অনুমান করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
তারা মনে করেন, নতুন এই বিমানটি সোভিয়েত আমলের এএন–১২৪ এর মতোই বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্যও নকশা করা হতে পারে, যা এর উৎপাদন সংখ্যা বাড়াতে সহায়ক হবে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার নিজস্ব পরিবহন বিমান উন্নয়ন প্রকল্প বিলম্বিত হলে, চীন এই নতুন বিমানটি রপ্তানিও করতে পারে, এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
সব মিলিয়ে, নতুন এই ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফট কেবল চীনের সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের সক্ষমতাই বাড়াবে না, বরং বিশ্বমঞ্চে পিএলএ এয়ার ফোর্সের উপস্থিতি ও কৌশলগত পরিধি আরও শক্তিশালী করবে বলে বিশ্লেষকদের মত।