ট্রাম্পের ‘জিরো মাইগ্রেশন আমেরিকা’ যেভাবে আমেরিকাকেই দরিদ্র ও মেধাশূন্য হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে

১৯৫০-এর দশক থেকে প্রতি বছর যত লোক আমেরিকা ছেড়েছেন, তার চেয়ে বেশি লোক সেখানে এসেছেন। তবে, দীর্ঘ সাত দশক ধরে চলে আসা অভিবাসন প্রবাহের এই ধারা উল্টে দিয়ে ২০২৫ সাল নাগাদ 'শূন্য অভিবাসন আমেরিকায়' পরিণত হতে চলেছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র।
জো বাইডেনের প্রেসিডেন্সির শেষ সময়েও যেখানে বছরে ২৫ লাখের বেশি মানুষ অভিবাসী হিসেবে আমেরিকায় প্রবেশ করতেন, সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর নীতির কারণে এই সংখ্যা শূন্যে নেমে আসতে পারে, এমনকি মাইনাসেও নামার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের এই অভিবাসন নীতি কেবল আমেরিকার সাফল্যের মূল স্তম্ভকেই নড়বড়ে করছে না, এটি দেশের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী ক্ষতি বয়ে এনে আমেরিকানদের দরিদ্রও করে তুলবে।
'শূন্য অভিবাসন আমেরিকা'র পথে
১৯৫০-এর দশক থেকে প্রতি বছরই আমেরিকায় আসা মানুষের সংখ্যা যাওয়ার চেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের অভিবাসন নীতি এই ঐতিহাসিক ধারাকে ভেঙে দিচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন শ্বাসরুদ্ধকর উদ্যমে এই 'শূন্য অভিবাসন' নীতি কার্যকর করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
মেক্সিকো সীমান্তে প্রবেশাধিকার কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। হাতেগোনা কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণ আফ্রিকান ছাড়া এখন আর কাউকেই সহজে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। অবৈধ অভিবাসনের একটি পরিমাপক 'এনকাউন্টার'-এর সংখ্যা মেক্সিকো সীমান্তে তলানিতে ঠেকেছে। ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট (আইসিই)-কে বহিষ্কার অভিযান আরও বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বিদেশি-বিরোধী অনেক রাজনীতিবিদ সাধারণত কম-দক্ষ এবং উচ্চ-দক্ষ অভিবাসীদের মধ্যে পার্থক্য করলেও, ট্রাম্প উচ্চ-দক্ষদেরও নিশানায় নিয়েছেন। প্রতি এইচ-১বি ভিসার (প্রতিভাবান অভিবাসীদের প্রধান প্রবেশ অনুমতি) জন্য ১ লাখ ডলার ফি নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি।
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চালানো আক্রমণের কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকরাও ভয় পেয়ে দূরে সরে যাচ্ছেন। এই নীতিগুলো আমেরিকার অভিবাসন ইতিহাসে এক বিপ্লবকে উপস্থাপন করছে, যার ফল হবে সুদূরপ্রসারী এবং বেদনাদায়ক।
যেমন, 'ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন' প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর সাতজন বসের মধ্যে চারজনই বিদেশে জন্মগ্রহণ করেছেন এবং তিনজন শিক্ষার্থী ও দক্ষ কর্মী হিসেবে আমেরিকায় প্রবেশ করেছিলেন – যা এখন হোয়াইট হাউসের নিশানায় রয়েছে। অন্যদিকে, আমেরিকার অর্ধেক কৃষি শ্রমিক এবং এক-চতুর্থাংশ নির্মাণ শ্রমিক অভিবাসী, যাদের অনেকেই অবৈধভাবে এসেছেন।
জনসংখ্যা হ্রাস এবং কর্মীবাহিনীর ধীর গতিশীলতা আমেরিকার অর্থনীতির আকার ছোট করে দেবে। জাতীয় ঋণ পরিশোধ করা আরও কঠিন হবে, বিশাল সামরিক বাহিনী রক্ষণাবেক্ষণও জটিল হয়ে দাঁড়াবে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, 'শূন্য অভিবাসন আমেরিকা' নীতি উৎপাদনশীলতার প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়ে মাথাপিছু জিডিপি হ্রাস করবে, যা দেশি-বিদেশি উভয় নাগরিককেই আরও দরিদ্র করে তুলবে।
শিল্পে কর্মী সংকট, ব্যবসায়ীদের কপালে ভাঁজ
আমেরিকার অসংখ্য শিল্প অভিবাসী কর্মীদের ওপর নির্ভরশীল। যেখানে বেকারত্বের হার ইতিমধ্যেই কম, সেখানে অভিবাসীদের আগমন বন্ধ বা বহিষ্কার হলে কোম্পানিগুলো কর্মী সংকটে ভুগবে। এর অর্থ হবে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া, উৎপাদন হ্রাস এবং খরচ বৃদ্ধি।
সান ডিয়েগোর চেম্বার অফ কমার্সের কেনিয়া জামারিপ্পা বলেন, সেখানকার ব্যবসায়ীরা 'প্রভাবের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন'। অভিবাসন কর্মকর্তাদের ভয়ে বৈধ শ্রমিকরাও কাজে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে কিছু ব্যবসায়ী জানিয়েছেন।
ট্রাম্প মাঝে মাঝে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পগুলোকে সুরক্ষার কথা বললেও, অভিবাসন নীতি সম্পূর্ণ ত্যাগ না করে এটি কীভাবে সম্ভব, তা স্পষ্ট নয়। এর আগে তুলনামূলকভাবে কম কঠোর দমন-পীড়নও অর্থনীতির ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল।
ইউনিভার্সিটি অফ ইউটাহর গবেষণা অনুসারে, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পরিচালিত এক বহিষ্কার অভিযান নির্মাণ শিল্পে শ্রমিকের তীব্র সংকট সৃষ্টি করে নতুন বাড়ির দাম এক-পঞ্চমাংশ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বর্তমান বন্ধ সীমান্ত নীতির প্রভাব আরও ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আসন্ন শ্রম সরবরাহ সংকট সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিণতি বয়ে আনবে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অভিবাসীদের ব্যাপক আগমন মহামারী-কালীন আর্থিক উদ্দীপনার কারণে সৃষ্ট চাহিদা পূরণ করেছিল। এর ফলে আমেরিকা মন্দা ছাড়াই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনেছিল, যা 'সফট ল্যান্ডিং' নামে পরিচিত।
বন্ধ সীমান্ত নীতিতে এই 'সফট ল্যান্ডিং' অর্জন করা অনেক কঠিন হতো। সান ফ্রান্সিসকো ফেডারেল রিজার্ভের ইভগেনিয়া দুজাক বলেছেন, ২০২৩ সালে শ্রমবাজারের কড়াকড়ি পরিমাপক 'শূন্যপদ-বেকার অনুপাত' হ্রাসের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নতুন অভিবাসীদের আগমনের কারণেই হয়েছিল। এখন, কম অভিবাসন এর বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে: মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিতে পারে এবং ফেডারেল রিজার্ভকে স্বাভাবিকের চেয়ে কঠোর মুদ্রা নীতি বজায় রাখতে বাধ্য করতে পারে।
ট্রাম্প প্রশাসনের নবনিযুক্ত ফেড গভর্নর স্টিফেন মিরান যুক্তি দিয়েছেন, কম অভিবাসনের ফলে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এই দাবিকে বাস্তবসম্মত মনে করছেন না। কারণ, অভিবাসন প্রবাহ কমলে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে নতুন বাড়ির দাম বাড়বে। এছাড়া, অন্যান্য শিল্পে কম অভিবাসনের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতির প্রভাবকেও তিনি হিসাবে আনেননি।
আমেরিকার মোট উদ্ভাবনের এক-তৃতীয়াংশের জন্য অভিবাসীরাই দায়ী, কিন্তু এইচ-১বি ভিসার জন্য ১ লাখ ডলার ফি নেওয়ার পরিকল্পনা এই খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। যদিও এই ফি ইতিমধ্যে আমেরিকায় থাকা ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য হবে না, গবেষণা খাতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পোস্ট-ডক্টরেট গবেষকরা সাধারণত এমন বেতন পান না, যা দিয়ে ১ লাখ ডলারের ভিসা ফি পরিশোধ করা সম্ভব। এই নীতি এবং অভিবাসন নীতি সম্পর্কে সামগ্রিক অনিশ্চয়তা অনেক মেধাবী বিদেশীকে আমেরিকায় পড়াশোনা করার পরিবর্তে অন্য কোথাও যেতে উৎসাহিত করবে।
এমন এক দুর্ভাগ্যজনক সময়ে আমেরিকা তার সীমান্ত বন্ধ করছে। নতুন অভিবাসীরা না এলে দেশের জন্মগত কর্মক্ষম জনসংখ্যা কমে যাবে। বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে সরকারি ব্যয় কর রাজস্বের চেয়ে অনেক বেশি হচ্ছে।
আমেরিকার বাজেট নিরীক্ষক সংস্থা কংগ্রেসনাল বাজেট অফিস (সিবিও) অনুমান করছে, বাইডেন-যুগের অভিবাসন প্রবাহ আগামী দশকে প্রতি বছর ৯০ বিলিয়ন ডলার বাজেট ঘাটতি কমাতে সাহায্য করবে। সিবিও আশা করে, এই অভিবাসীরা তাদের জন্য রাষ্ট্রের ব্যয়ের চেয়ে বেশি ফেডারেল ট্যাক্স দেবে এবং উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে অন্যান্য কর্মীদের কাছ থেকে কর আদায় বৃদ্ধি করবে। কিন্তু কম অভিবাসনের ফলে এর ঠিক বিপরীত ফল হবে।
বাইডেন প্রশাসনের অধীনে 'অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসন' নিয়ে জনমনে যে ক্ষোভ ছিল, ট্রাম্প তা কাজে লাগিয়ে লাভবান হয়েছিলেন। এখন জনমত বিপরীত দিকে ঘুরেছে: রেকর্ড সংখ্যক ৭৯ শতাংশ আমেরিকান মনে করেন, সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য অভিবাসন একটি ভালো বিষয়।
তবে সমস্যা হলো, ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের শুল্ক নীতির মতো অপ্রিয় ট্রাম্পীয় নীতিগুলোরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এবং প্রেসিডেন্ট যেন শূন্য অভিবাসন নীতি আরও তীব্র করার দিকেই বেশি আগ্রহী। এমনকি যদি তার উত্তরসূরি তিন বছরের মধ্যে আমেরিকার সীমান্তগুলো পুনরায় খুলে দেন, ততদিনে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।