বাসমতি চালের মালিকানা নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের দ্বন্দ্বে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা

ভারত-পাকিস্তানের সীমান্ত নির্ধারণের বহু আগেই লাহোরের কৃষকেরা এক ধরনের মূল্যবান লম্বা দানার চাল উৎপাদন করতেন, যা বিশ্বজুড়ে সমাদৃত ছিল। এই বাসমতি চাল 'সুগন্ধি মুক্তো' নামেও পরিচিত। ইতিহাসবিদদের মতে, একসময় হয়তো এটি রোমান সাম্রাজ্যেও রপ্তানি করা হয়েছিল। বর্তমানে বাসমতি চালের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ক্রমশ বাড়ছে। তবে এর উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে পৌঁছেছে, ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
বাসমতি চালকে একান্তই ভারতীয় পণ্য হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। তবে এতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে পাকিস্তান, দেশটির দাবি—এই চাল ভারত ও পাকিস্তানের যৌথ ঐতিহ্যের অংশ।
কিন্তু বাসমতির প্রধান উৎপাদন অঞ্চলের অনেকেই মনে করেন, দুই দেশের নেতারা আসল সমস্যাটিই উপেক্ষা করছেন। বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্ববাজারে বাসমতির চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে ২০৩২ সালের মধ্যে প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। তবে কৃষক ও বাসমতির স্বাদের আদত সমঝদারদের আশঙ্কা, এই ঐতিহ্যবাহী চাল ক্রমশ বিলুপ্তির পথে।
'বাসমতি' শব্দটি প্রাচীন ইন্দো-আর্য ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ 'সুগন্ধি' ও 'সৌরভময়'। এখানকার মানুষ এটিকে প্রায় ধর্মীয় আবেগের সঙ্গে বিবেচনা করেন। পাকিস্তানি শেফ মুহাম্মদ নওয়াজ বলেন, 'যে মুহূর্তে আপনি হাঁড়ির ঢাকনা তুলবেন, তখন যে বাষ্প বেরিয়ে আসবে সেটি এক বিশেষ অনুভূতি। সেই সুগন্ধ নাকে পৌঁছালে আপনাকে মোহিত করবে।'
বাসমতির স্বাদ কবে থেকে বদলাতে শুরু করেছে, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন না। তবে সবাই একমত—আজকের বাসমতি আর আগের মতো স্বাদ ও সুগন্ধ ধরে রাখতে পারছে না।
ভারতীয় কৃষকদের স্থানীয় বীজ সংরক্ষণে সহায়তাকারী পরিবেশবিদ দেবাল দেব মনে করেন, তরুণ কৃষকেরা বাসমতির জেনেটিক বিশুদ্ধতা রক্ষার ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি ভারত-পাকিস্তানের বাসমতি বিতর্ককে 'উভয় পক্ষের সময় ও শক্তির সম্পূর্ণ অপচয়' বলে মন্তব্য করেন।
১৯৮০-এর দশকে বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ভারত ও পাকিস্তানের কৃষকেরা দ্রুত পরিপক্ব ও অধিক ফলনশীল জাতের বাসমতি চাষ শুরু করেন। এতে চালের আসল স্বাদ ও গুণাগুণ নষ্ট হয়। এরপরের কয়েক দশকে ছোট কৃষি খামারের জায়গা দখল করে বড় কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলো। দ্রুত ফসল সংগ্রহ, সংক্ষিপ্ত প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মাটির অবক্ষয় ঘটায়, যা বাসমতির স্বাদ ও সুগন্ধ ম্লান করে দিয়েছে।
তবে নতুন জাতের চাল তুলনামূলক সস্তা ও রান্নায় সহজ। রপ্তানিকারকদের মতে, পশ্চিমা ক্রেতাদের বেশিরভাগই আসল বাসমতির স্বাদ বুঝতে পারেন না।
লাহোরসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ কৃষি অঞ্চলের অনেকেই মনে করেন, খাঁটি বাসমতি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানের জাতীয় নায়ক হিসেবে পরিচিত বাসমতি গবেষক ফয়সাল হাসানের বাবা ১৯৬০-এর দশকে জনপ্রিয় বাসমতি জাত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ফয়সাল হাসান বলেন, 'আমরা এর প্রকৃত সংজ্ঞাই বদলে ফেলেছি। এটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।'
বাসমতি চাল পাঞ্জাব অঞ্চলের ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত। এই অঞ্চলে আজকের ভারতের একটি রাজ্য ও পাকিস্তানের একটি প্রদেশ অবস্থিত। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ২০০০ বছর আগে এখানেই বাসমতির প্রাথমিক সংস্করণ চাষ করা হয়েছিল। লিখিত নথিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৬শ শতকে, যখন মুঘল সাম্রাজ্য ভারতীয় উপমহাদেশের বৃহৎ অংশ শাসন করছিল। পাকিস্তানি রপ্তানিকারক রাজা আরসালান উল্লাহ খান বলেন, 'এটি ছিল সম্রাট ও রাজাদের খাবার।'
১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথমবারের মতো একটি মানকৃত বাসমতি জাতকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়। সে সময় এই গবেষণা যেসব এলাকায় চালানো হয়েছিল, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সেগুলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাসমতি চাল রাতারাতি আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয় হয়নি। প্রথমদিকে এটি মূলত মধ্যপ্রাচ্যের ভোক্তাদের পাশাপাশি ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
প্রথম থেকেই ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের বাসমতিকে সেরা প্রমাণের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল এবং এর নামের স্বত্বাধিকার নিয়ে বিবাদে জড়ায়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি কৃষকেরা অভিযোগ করেন, ভারতীয় সৈন্যরা তাদের বাসমতি বীজ চুরি করেছে। পাল্টা অভিযোগে ভারত দাবি করে, পাকিস্তান তাদের উন্নত জাতগুলোর অনুকরণ করেছে।
তবে ভারতের মেধাস্বত্ব বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক গণেশ হিংমির মতে, 'গুণমান নিম্নমানের হলে সেটিকে নিজের বলে দাবি করার অধিকার আপনার নেই।'
বর্তমানে বাসমতি বাজারে ভারতের আধিপত্য স্পষ্ট। সুসংগঠিত বিপণন কৌশল ও রপ্তানি নীতির কারণে দেশটি পাকিস্তানের তুলনায় অনেক এগিয়ে গেছে। পাকিস্তান এই প্রতিযোগিতায় অনেক দেরিতে এসেছে বলে মনে করেন লাহোরের চাল সরবরাহকারী সাবুর আহমেদ।
২০১৮ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন কীটনাশক বিধিনিষেধের কারণে ভারতীয় বাসমতির রপ্তানি ব্যাহত হয়। পাকিস্তান এমন আরেকটি সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।
ভারতের বাসমতি ব্যবসার কৌশলবিদ যোগরাজদীপ সিং বলেন, 'সত্যি বলতে তাদের চালের জাতও আমাদের মতোই। আমরা এ নিয়ে এত লড়াই করছি কেন?'
নয়াদিল্লির বাসমতির স্বত্ব নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থমকে আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভারতের একটি মামলা এখনো মুলতবি থাকলেও অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ইতোমধ্যে একই ধরনের দাবি খারিজ করেছে।
পাকিস্তানে এখনো কতটা ঐতিহ্যবাহী বাসমতি উৎপাদন হয়, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। তবে রপ্তানিকারক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশটির বেশিরভাগ উৎপাদিত বাসমতি এখন উচ্চফলনশীল নতুন জাতের। ২০১৯ সালে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যে উৎপাদিত মোট বাসমতির প্রায় ৭০ শতাংশই ছিল নতুন জাত 'পুসা বাসমতি ১১২১' বা 'পিবি ১১২১'।
এই প্রবণতা কমার কোনো লক্ষণ নেই। এক গবেষণা অনুসারে, পিবি ১১২১ চাষ করে ভারতীয় কৃষকেরা হেক্টরপ্রতি গড়ে ১,৪০০ ডলার আয় করেছেন, যা পুরোনো জাতগুলোর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
ভারতীয় পরিবেশবিদ দেবাল দেব ঐতিহ্যবাহী বাসমতি সংরক্ষণে কাজ করছেন। তিনি বলেন, 'আমরা প্রতিটি জাতের জেনেটিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখি এবং পরে সেগুলো কৃষকদের বিনামূল্যে বিতরণ করি।' তবে বাসমতির আসল স্বাদ ও গন্ধ টিকিয়ে রাখতে আরও ব্যাপক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
পাকিস্তানে অনেকেই মনে করেন, বাসমতি তাদের খাবারের টেবিলে সবসময় থাকবে। তবে লাহোরের রেস্টুরেন্ট মালিক ফকির হুসাইন বলেন, 'সম্ভবত একদিন মানুষ ভুলেই যাবে যে খাঁটি বাসমতি নামে কিছু ছিল।'