ইসরায়েলি হামলায় আতঙ্কিত বাচ্চাদের যেভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করছেন গাজার মায়েরা

হাজার হাজার পাউন্ড ওজনের শক্তিশালী বিস্ফোরক বোঝাই বোমা ফেলা হচ্ছে গাজায়। চারদিক প্রকম্পিত করে ঘটছে গগণবিদারী বিস্ফোরণ। ঘটছে মৃত্যু, প্রচণ্ড শব্দে স্নায়বিক ও মানসিক চাপে ভুগছে শিশুরা। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার দিকে এগোচ্ছে তারা। গাজার মায়েরা, অভিভাবকেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন তা ঠেকাতে।
গাজাবাসী আট বছরের ফুটফুটে মেয়ে প্রীতি আবু গাজ্জাহ, বিমান হামলার প্রচণ্ড শব্দে আতঙ্কে অসার হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তার ছোট দুই জমজ ভাই তখন দৌড়ে ছুটে যায় মা এরসা'র কোলে। প্রীতির সবচেয়ে ছোট – দুই বছরের ভাইটি বিকট শব্দে ভয় পেয়ে জোরে জোরে কাঁদতে থাকে।
গাজা সিটির মধ্যাঞ্চলে দেইর এল-বালাহ এলাকায় বাড়ি ছিল এ পরিবারের। সেখানে ইসরায়েল বিপুল হারে বোমা ফেলছে। ফলে সন্তানদের নিয়ে এরসা আশ্রয় নিয়েছেন তুলনামূলকভাবে কম বোমা পড়ছে এমন একটি এলাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে।
কিন্তু, তবুও ইসরায়েলি বোমা হামলার মানসিক আঘাত ঠিকই পড়ছে শিশুমনে।
৩০ বছরের এরসা বলেন, 'আতঙ্কে সন্তানদের থরথর করে কাঁপা, ওদের চেহারা রক্তশুন্য হয়ে পড়া দেখে আমি সইতে পারি না। ভয় ও আতঙ্কে প্রীতি আজ দিনে কয়েকবার বমি করেছে।'
গাজার অবরুদ্ধ ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে অর্ধেকই হলো শিশু। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা ইসরায়েলি অবরোধ ও সহিংসতার মধ্যে তারা মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে আবেগীয় দিক থেকেও ভেঙ্গে পড়ছে।
অলাভজনক সহায়তা সংস্থা– সেভ দ্য চিলড্রেন এর ২০২২ সালের এক গবেষণামতে, গাজার প্রতি পাঁচ শিশুর মধ্যে চারজন হতাশা, শোক ও আতঙ্কগ্রস্ত।

হামাসের আক্রমণের পর গত ৭ অক্টোবর থেকেই গাজায় বোমা ফেলছে ইসরায়েল। এতে এপর্যন্ত অন্তত ২ হাজার ৩৮২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহতের সংখ্যা ৯ হাজার ৭১৪ জন। ভয়াবহ এই পরিবেশে সন্তানদের প্রাণ বাঁচাতে মরিয়া প্রত্যেক বাবা-মা; একইসঙ্গে মানসিকভাবে তাদের সুস্থ রাখাটা হয়ে পড়েছে দুঃসাধ্য। বিশেষত, যখন বিগত বছরগুলোর মধ্যে বর্তমানেই সবচেয়ে প্রচণ্ড হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েল।
এই অবস্থায় অনেক অভিভাবকই শিশুদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে কী করণীয়, তা জেনে নিচ্ছেন ইউটিউব ভিডিও থেকে বা হোয়াটসঅ্যাপের মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শকদের থেকে। কিন্তু, গাজায় ইন্টারনেট সেবা খুবই সীমিত, ইসরায়েলি হামলায় বিদ্যমান নেটওয়ার্কও ব্যাহত। তারমধ্যে গত সোমবার থেকেই গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। জেনারেটর চালানোর মতো জ্বালানিও ফুরিয়ে আসছে। এই অবস্থায়, অভিভাবকরা সামাজিক মাধ্যমে সহজে যুক্তও হতে পারছেন না।
অবিরাম বিমান হামলার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে এরসার বাচ্চাদের ওপর, যা লক্ষ করে রীতিমতো উদ্বিগ্ন তিনি। ভয়ে তারা বমির পাশাপাশি, অনিচ্ছকৃতভাবে প্রস্রাবও করে ফেলছে। শেষোক্ত এই লক্ষণটি আগে ছিল না তাদের, বরং বিগত কয়েকদিনের বোমা হামলার মধ্যেই প্রথম দেখা দেয়। এখন তারা মাঝেমধ্যেই আতঙ্কে প্রস্রাব করে ফেলে বলে জানান এরসা।
তিনি বলেন, 'আগে আমার বাচ্চাদের মধ্যে অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রস্রাব করার এই সমস্যা ছিল না।'
২০২২ সালে প্রকাশিত সেভ দ্য চিলড্রেন এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার ৭৯ শতাংশ অভিভাবক শিশুদের রাতের বেলায় বিছানায় প্রস্রাব করার কথা জানিয়েছেন। ২০১৮ সালে ৫৩ শতাংশ অভিভাবক এমনটা জানান। বর্তমান সংঘাতের আগে ২০২১ সালে সর্বশেষ হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যেকারণে ২০১৮ সালের তুলনায় শিশুদের মধ্যে কথা বলার সমস্যা অনেকগুণ বেড়েছে। তারা সঠিক ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে বা যোগাযোগ করতেও সমস্যার মধ্যে পড়ছে।
এরসা বলেন, 'এমন সংকটের সময় কীভাবে শিশুদের সাথে কথা বলা উচিত, গত যুদ্ধের সময় (২০২১ সাল) আমি ইউটিউবে এমন অনেক ভিডিও খুঁজে পাই, যা অনেক সাহায্য করেছে। আমি বুঝতে পারি, সংকটের সময়ে ওদের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে হবে, চারপাশে যা ঘটছে সেটা তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে।'
কিন্তু, ইসরায়েলের বর্বর, নিষ্ঠুর হামলার মধ্যে শিশুদের ভয় কমানোর এই কৌশল অকার্যকর হয়ে পড়েছে বলে জানান এরসা। মর্মান্তিক যে বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে গাজার শিশুরা যাচ্ছে, তাতে পূর্ণবয়স্ক মানুষেরও মানসিক সুস্থতা হারানো স্বাভাবিক– সেখানে কোমল শিশুমনের অবস্থা অনুমান করা কঠিন নয়।

শিশুদের অন্যদিকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা
সংঘাতের সময় শিশুতোষ অনলাইন কন্টেন্ট দেখিয়ে বাচ্চাদের মনোযোগ সেদিকে রাখা কার্যকর হতে পারে বলে এরসা বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, 'সাধারণত ওদের আইপ্যাড ব্যবহার আমি সীমিত রাখতাম, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমি ওদের কার্টুন দেখতে বাধা দেই না। আমার আইপ্যাড বা ফোনে যথেষ্ট পরিমাণে চার্জ আছে কিনা- শুধু সেটা খেয়াল রাখি।'
অনলাইন কন্টেন্ট দেখতে দেওয়ার পাশাপাশি বাচ্চাদের গল্পও পড়ে শোনান এরসা।
আগের বারগুলোর মতো আবাসিক বসতবাড়িতে হামলার আগে সতর্কবার্তাও দিচ্ছে না ইসরায়েল। ফলে হামলার মুখে পরিবারগুলোকে পালাতে হচ্ছে। কখনো কখনো নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর আগেই বোমা বা গোলার আঘাতে মারা পড়ছে তারা।
২০২২ সালে 'হিউম্যানিটারিয়ান নিডস ওভারভিউ' শীর্ষক প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমর্কিত সমন্বয়ক দপ্তর হিসাব করে যে, ফিলিস্তিনের অন্তত ৬ লাখ ৭৮ হাজার শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা দরকার। গাজার অন্তত অর্ধেক শিশুর এ ধরনের সহায়তা দরকার।
কিন্তু, গাজায় মানসিক বা শিশু মনোরোগ বিষয়ক সেবা অপ্রতুল। সংঘাতের সময়ে যার অভাব আরও মারাত্মকভাবে দৃশ্যমান হয়। অনেক বাবা-মা নিজেরাই মানসিক সমস্যার সম্মুখীন, তারমধ্যে আতঙ্কিত শিশুদের সান্তনা দেওয়ার ভাষাই খুঁজে পান না।
এরসা জানান, এখন তার বাচ্চাদের খেলার মধ্যেও যুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসে। যুদ্ধের সময় যেভাবে তিনি ফোনকল করে প্রিয়জনদের খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, সেটা অনুকরণ করে কাল্পনিক ফোনকলে কথা বলে বাচ্চারা। যেমন জানতে চায়, "তোমার এলাকার খবর কী? তোমরা সবাই ঠিক তো?- এমন নানান প্রশ্ন।
মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছে না
রাওয়ান নামের আরেক জননী জানান, তার তিন মেয়ে এই সহিংস বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারছে না।
তিনি বলেন, 'একজন মা হিসেবে পঞ্চমবার যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। সংঘাতের মধ্যে কীভাবে আমার মেয়েদের সুস্থ রাখতে পারি, তা জানতে অনলাইন প্রবন্ধ ও ইউটিউবের সাজায্য নিয়ে থাকি।'
কিন্তু, তার বড় মেয়ের উচ্চারণে সমস্যা হচ্ছে। রাওয়ান বলেন, আমার তিন মেয়ে, আয়সেল ৯ বছরের, আরিন ৬ বছরের ও আলিন ৪ বছর বয়সী। বোমা বিস্ফোরণের ভীতিকর শব্দে তারা মারাত্মক প্রভাবিত হয়েছে। বিশেষত, বড় মেয়ে আইসেল। কারণ, যুদ্ধের ভয়াবহতা বোঝার মতো যথেষ্ট বড় সে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করেছে সে। মাঝেমধ্যেই ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়াটাও লক্ষ করেছি।'
রাওয়ান জানান, মেজ মেয়ে আলিনের মধ্যেও খাবার খেতে অনীহা দেখা দিয়েছে। এমনকী ভয়ে তার শরীরে কাঁপুনি দেখা দিচ্ছে।
বাচ্চাদের এই আতঙ্ক কমাতে, তাদের একসাথে খেলাধুলায় বা কোন কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন রাওয়ান।
সঠিক দিকনির্দেশনার জন্য ইউটিউবের মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শকদের ভিডিও দেখছেন। আবার তার কন্যার স্কুল শিক্ষকরাও ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন, সেগুলোও মেনে চলেন রাওয়ান।
শিক্ষকদের দেওয়া একটি পরামর্শ হলো, বাচ্চাদের মধ্যে আতঙ্ক বা উদ্বেগের লক্ষণগুলোর বিষয়ে সতর্ক নজর রাখা, কারণ অনেক সময়েই তারা এ ধরনের মনের ভাব মুখ ফুটে প্রকাশ করতে পারে না। এই অবস্থায় মায়েদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, তারা যেন সৃজনশীলভাবে তা জানাতে বাচ্চাদের উৎসাহ দেন। যেমন যেমন গল্পের আকারে লিখে বা ছবি এঁকে মনের ভাব প্রকাশ করতে বলেন।
গাজা সিটির আল-নাসের এলাকায় বাসা ছিল রাওয়ানের পরিবারের। ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর প্রথম তিনদিন সেখানেই ছিলেন সবাই। কিন্তু, ওই এলাকায় বোমা হামলার তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় দেইর আল-বালাহ এলাকার নিকটবর্তী শরণার্থী শিবিরে চলে আসেন তারা।
ঠিকানা বদলেও লাভ হয়নি তেমন, এরসার মতোন রাওয়ানের সন্তানেরাও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অসহায়কণ্ঠে রাওয়ান বলেন, 'ভয়ে তারা সবসময় আমার গা ঘেঁষে থাকে। এমনকী যখন আমি রান্না করি, তখনও। আমিও যত ঘন ঘন সম্ভব ওদের জড়িয়ে ধরে, সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করি।'
মেয়েরা যুদ্ধের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে, তাদের শান্তির সময়কার বিভিন্ন পারিবারিক অনুষ্ঠানের ছবি বা ভিডিও দেখান রাওয়ান। তাদের মনোযোগ নিতে চান অন্যদিকে। তাদের সাথে খেলায় মাতেন, নাহলে একসাথে পড়েন কোনো গল্প।
তবে এরসার মতো বাচ্চাদের বেশি বেশি মোবাইল ফোন বা আইপ্যাড ব্যবহার করতে দেন না রাওয়ান। বরং, জরুরি পরিস্থিতিতে এসব ডিভাইস ব্যবহার করতে চান।
মানসিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা
মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও মনোরোগ চিকিৎসকদের কেউ কেউ সামাজিক মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন। সম্প্রতি এক ফেসবুক পোস্টে ফিলিস্তিনের কাউন্সেলিং সেন্টার– মানসিক পরামর্শের দরকারে থাকা অভিভাবকদের জন্য ফোনকলে বা হোয়াটঅ্যাপে বিনামূল্যে মনোরোগ পরামর্শ দিতে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি টিম গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। পোস্টে এই টিমে যোগ দেওয়া ফিলিস্তিনি বিশেষজ্ঞদের ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। বোমা ও গোলাবর্ষণের সময় শিশুদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখার নানান পরামর্শও কাউন্সেলিং সেন্টারের পেইজে দেওয়া হয়েছে।
গাজার একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মুয়াইয়াদ জৌদা ব্যাখ্যা করেন, 'ইসরায়েলি আগ্রাসনে শিশুরা অবধারিতভাবেই প্রভাবিত হয়। তাছাড়া, গণমাধ্যম ও ভিডিও ফুটেজ বা ছবিতে ক্ষতবিক্ষত অজস্র হতাহতদের দেখে, অবিরাম বিস্ফোরণের শব্দে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে।'
তিনি জানান, মানসিকভাবে অসুস্থ শিশুদের মধ্যে রাগ বেড়ে যাওয়া, ক্রমাগত কান্না বা দীর্ঘসময় ধরে চিৎকার-চেঁচামেচির করার মতোন বিভিন্ন লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অসুস্থতার আরেকটি লক্ষণ হতে পারে, তাদের মধ্যে শুধু চলমান যুদ্ধ নিয়েই আলোচনা হওয়া, এমনকি খেলার সময়েও সহিংসতা, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় টেনে আনে তারা।