ওয়াগনার বিদ্রোহ: দক্ষিণ রাশিয়ার সামরিক দপ্তর দখলের দাবি প্রিগোজিনের

রুশ ভাড়াটে সেনাবাহিনীর দল 'ওয়াগনার গ্রুপ'-এর প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিন ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী দক্ষিণাঞ্চলের রুশ শহর রোস্তভে অবস্থিত দক্ষিণ রাশিয়ার সামরিক দপ্তর দখলেরও দাবি করেছেন তিনি।
ওয়াশিংটন পোস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রিগোজিন একদল সৈন্য নিয়ে আচমকা রোস্তভে প্রবেশ করে রুশ বাহিনীর বড় ধরণের বাঁধা ছাড়াই ক্যাম্পের দখল নেয়। সেখানকার বিমানঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ মিলিটারি বস্তুগুলোও নিজেদের আয়ত্তে নিয়েছে ওয়াগনার গ্রুপ।
তবে দখলকৃত সামরিক দপ্তর ও বিমানঘাটি পূর্বেই মতোই ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাবে বলে গ্রুপটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। ওয়াগনার বস বলেন, "আমাদের বিরুদ্ধে হামলা না হয়ে বরং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যাতে হামলা করা যায়, সেজন্য আমরা এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছি।"
এদিকে আজ (শনিবার) প্রিগোজিন জানান, ওয়াগনার সেনারা ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের রণাঙ্গন থেকে রুশ সীমান্তে প্রবেশ করেছে। গ্রুপটি মস্কোর সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে প্রস্তুত।
অনলাইনে ছড়িয়ে পরা এক ভিডিওতে দেখা যায়, রোস্তভে অবস্থিত রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সামরিক দপ্তরে ঢুকছেন প্রিগোজিন।
ভিডিওতে প্রিগোজিন বলছেন তার সৈন্যরা শহর ঘেরাও করে নেবে এবং মস্কোর দিকে যাত্রা শুরু করবে যদি প্রতিরক্ষা প্রধান সের্গেই সুইগো এবং ভ্যালেরি গেরাসিমভ তার সাথে দেখা না করেন।
রয়টার্সের পক্ষ থেকে ভিডিওর স্থানটি যে রুশ সামরিক দপ্তর, সেটি নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে ঠিক কখন এটি রেকর্ড করা হয়েছে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
রাশিয়ান সংবাদ সংস্থা তাস নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে, প্রিগোজিন এবং রুশ সামরিক শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে চলমান অচলাবস্থা এবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
ইতোমধ্যেই রাশিয়ার 'এফএসবি নিরাপত্তা পরিষেবা' প্রিগোজিন এর বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করেছে। একইসাথে মস্কোর পক্ষ থেকে ওয়াগনার বাহিনীকে তার আদেশ উপেক্ষা করে গ্রেফতারের আহ্বান জানানো হয়েছে।
মূলত প্রিগোজিন টেলিগ্রামে একাধিক অডিও বার্তার মাধ্যমে এ বিদ্রোহের কথা জানান। এতে ওয়াগনার বস বলেন, "ওয়াগনার যোদ্ধারা রুশ নগরী রোস্তভে প্রবেশ করেছে। রুশ সামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করতে প্রয়োজনীয় সব কিছুই করা হবে। আর এই পথে যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়াবে তা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।"
প্রিগোজিন জানান, তার গ্রুপের বহু সৈন্যকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় হত্যা করা হয়েছে। এজন্য রাশিয়ান সামরিক বাহিনীকে অভিযুক্ত করেন ওয়াগনার প্রধান। একইসাথে এ হামলার কঠিন প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
প্রিগোজিন বলেন, "ইউক্রেনে পর্যাপ্ত অস্ত্র ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে রুশ পক্ষের সৈন্যরা মৃত্যুবরণ করছেন।"
ওয়াগনার বস আরও বলেন, "তার পদক্ষেপ সামরিক অভ্যুত্থানের মতো নয়। তবে এটা ন্যায়বিচারের জন্য এগিয়ে যাওয়া।"
এদিকে ওয়াগনার গ্রুপ রাশিয়ার একটি সামরিক হেলিকপ্টারকে গুলি করে ভূপাতিত করেছে বলেও দাবি করেছেন প্রিগোজিন। তার ভাষায়, "এইমাত্র বেসামরিক একটি স্তম্ভের ওপর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়েছে। ওয়াগনার গ্রুপ হেলিকপ্টারটিকে ভূপাতিত করেছে।"
যদিও টেলিগ্রামে পাঠানো অডিও বার্তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। এটি সত্যিকার অর্থেই হাজার হাজার শক্তিশালী মিলিশিয়ার নেতৃত্বে থাকা ওয়াগনার প্রধানের কণ্ঠ কি-না সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তাস নিউজ এজেন্সির রিপোর্ট অনুযায়ী, গতকাল রাত থেকে সতর্কতার অংশ হিসেবে মস্কোর সরকারি ভবন, পরিবহন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
রোস্তভ থেকে ৫০০ কিলোমিটার উত্তরে লিপেটস্ক অঞ্চলের গভর্নর ইগর আর্টামনভ বলেছেন, "অঞ্চলটিতে নিরাপত্তা জোরদারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আমি সবাইকে শান্ত থাকতে বলছি।"
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। 'সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রচেষ্টা'কে 'বিশ্বাসঘাতকতা' ও জাতির জন্য 'হুমকিস্বরূপ' বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোজিনসহ এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে বলে জানান পুতিন। তিনি বলেন, "রুশ নাগরিক হিসেবে, আমি দেশকে রক্ষা করার জন্য সবকিছু করব। সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সেগুলো হবে কঠোর।"
অন্যদিকে ওয়াইট হাউজও এ পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের সাথে তারা পরামর্শ করবে বলেও জানিয়েছে।
আর কিয়েভের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মস্কোর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা আরও বড় আক্রমণ করা হবে। একজন শীর্ষ ইউক্রেনীয় জেনারেল দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে যুদ্ধে 'আকাঙ্ক্ষিত সাফল্য' অর্জনের কথা জানিয়েছেন।
ইউক্রেনের উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হান্না মালিয়ায় বলেন, "আসল আঘাত হানা এখনো বাকি আছে।"
এমতবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার যৌথ বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার জেনারেল সের্গেই সুরাভাইকিন টেলিগ্রামে এক ভিডিও পোস্ট করেছেন। তিনি ভিডিওতে ওয়াগনার সৈন্যদের প্রেসিডেন্ট পুতিন ও রুশ কমান্ডের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ঘাঁটিতে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
সের্গেই সতর্ক করে বলেছেন, "রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে রাশিয়ার শত্রুরা আমাদের নিয়ে খেলবে। আমি আপনাদের থামার আহ্বান জানাচ্ছি।"
একসময় প্রিগোজিন ছিল প্রেসিডেন্ট পুতিনের খুবই বিশ্বস্ত সহচর। তবে গত কয়েক মাস ধরেই তিনি রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই সুইগো ও শীর্ষস্থানীয় জেনারেল ভ্যালেরি গেরাসিমোভের বিরুদ্ধে 'অযোগ্যতার' অভিযোগ করে আসছিল।
চলমান এই পরিস্থিতির বিস্তারিত অনেক কিছু এখনও পরিষ্কার হয়নি। তবে এমতবস্থায় ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে পুতিন সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত মাসে ওয়াগনার গ্রুপের নেতৃত্বে রাশিয়া ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর বাখমুত দখল করে নেয়। যা গত ১০ মাসের মধ্যে রুশ বাহিনীর সবচেয়ে বড় বিজয়।