ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তি, পারমাণবিক শক্তি বাড়ানোর আভাস দিলেন পুতিন

বৃহস্পতিবারের ডিফেন্ডার অফ দ্য ফাদারল্যান্ড উপলক্ষে ছুটির দিন এবং ইউক্রেন আক্রমণের বর্ষপূর্তির একদিন আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, রাশিয়া পারমাণবিক শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর অব্যাহত রাখবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তিকে মুলতবি রাখার কথাও ঘোষণা করেন তিনি।
ল্যান্ড, সি এবং এয়ার নিউক্লিয়ার মিসাইলের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "আগের মতো এখন থেকে আমরাও নিউক্লিয়ার মিসাইল বহর বাড়ানোর দিকে নজর দেব।"
পুতিন জানান, এই প্রথমবারের মতো একাধিক নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড বহন করতে সক্ষম সারমাত ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল এই বছর যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হবে।
গত মঙ্গলবার ক্রেমলিনের ঘোষণাকে উল্লেখ করে বলেন, "আমরা এয়ার-বেজড হাইপারসনিক কিনঝাল সিস্টেম এবং সি-বেজড জিরকন হাইপারসনিক মিসাইলের ব্যাপক উৎপাদন অব্যাহত রাখবো।"
আল জাজিরার তথ্যানুযায়ী, রাশিয়ার কাছে সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ রয়েছে। প্রায় ৬ হাজার ওয়্যারহেড রয়েছে তাদের কাছে। একইসাথে, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ পারমাণবিক ওয়্যারহেড রয়েছে, যা পৃথিবীকে বহুবার ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট।
শুক্রবার থেকে চীনের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকায় একটি যৌথ মহড়া চালাবে রাশিয়া, এ কারণে সেখানে হাইপারসনিক মিসাইল বহন করা একটি ফ্রিগেট পাঠিয়েছে তারা।
ইউক্রেন যুদ্ধের বর্ষপূর্তির আগে পুতিন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এক বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছেন, যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ দুই পরাশক্তির বৈশ্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছে।
ইউক্রেনকে অস্ত্র পাঠিয়ে একে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধে পরিণত করেছে যুক্তরাষ্ট্র বলে অভিযোগ করেছেন পুতিন। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নিউ স্টার্ট (স্ট্র্যাটেজিক আর্মস রিডাকশন ট্রিটি) চুক্তিও মুলতবির ঘোষণা দেন।
সোমবার ইউক্রেনে একে ঝটিকা সফর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। জানান, যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্ররা ইউক্রেনে গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা রক্ষা করচেন।
পুতিন স্টার্ট চুক্তি মুলতবি করার পর বাইডেন বুধবার পোল্যান্ড সফরের সময় বলেন যে, এটি একটি 'বড় ভুল'। "আমি মনে করছি না সে [পুতিন] যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করার কথা চিন্তা করছে।"
তবে একজন সিনিয়র রুশ প্রতিরক্ষা কর্মকর্তার মতে, মস্কো পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের বিষয়ে চুক্তি অনুযায়ী অস্ত্র সীমাবদ্ধ রাখবে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এর ডেপ্লয়মেন্ট সম্পর্কে অবহিত করতে থাকবে।
ওয়ারশতে ন্যাটোর পূর্বাঞ্চলের দেশগুলোর নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করার পর বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র 'ন্যাটোর প্রতিটি ইঞ্চি রক্ষা করবে'।
ক্রেমলিনের মতে, তারা ন্যাটকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে, যারা শীঘ্রই সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডকে নিজেদের সীমানার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে সংঘাত ইউক্রেন যুদ্ধ, যা ইতিমধ্যেই লক্ষ লক্ষ লোককে বাস্তুচ্যুত করেছে, ইউক্রেনের নগর, শহর ও গ্রামগুলিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে ব্যাহত করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বুধবার রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনকে জাতিসংঘের চার্টার এবং আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে নিন্দা করেন, একইসাথে পারমাণবিক অস্ত্রের সম্ভাব্য ব্যবহার সম্পর্কে এর হুমকির ব্যাপারেও সমালোচনা করেন।
গত সেপ্টেম্বর পুতিন এক ভাষণে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, প্রয়োজনে তিনি রাশিয়াকে রক্ষা করতে পারমাণবিক অস্ত্রও ব্যবহার করবেন।
গুতেরেস বলেন, "আমরা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের অন্তর্নিহিত হুমকি শুনেছি। তথাকথিত পারমাণবিক অস্ত্রের কৌশলগত ব্যবহার একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। এখনই সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়ানোর উপযুক্ত সময়।"
চীনের ভূমিকা
গত বুধবার পুতিন চীনের শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইকে ক্রেমলিনে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি চীন-রাশিয়ার সম্পর্ককে 'নতুন দিগন্তে' পৌঁছিয়েছে বলে ঘোষণা দিয়ে বলেন, চীনা নেতা শি জিনপিং রাশিয়া সফর করবেন।
শি শুক্রবার একটি 'শান্তি ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে ভাষণ' দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে, তবে ইউক্রেনের মতে, রুশ সৈন্যরা তাদের ভূখণ্ড দখল করে রাখা অবস্থায় সেখানে শান্তির বিষয়ে কোনো আলোচনা হতে পারে না।
বেইজিং ইউক্রেনে রাশিয়াকে সহায়তা করতে পারে বলে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র।
তাস নিউজ এজেন্সি ওয়াং-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছে, যে চীন 'দৃঢ়ভাবে একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকবে এবং এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধানে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে'।
ওয়াং একজন দোভাষীর মাধ্যমে বলেছেন, চীন এবং রাশিয়ার মধ্যকার এই সম্পর্ক কোনো তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে নয়। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে বলেন, তারা 'তৃতীয় কোনো পক্ষের চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না'।
গত বছর 'বিশেষ সামরিক অভিযানে' বড় তিনটি ধাক্কা খাওয়ার পরও রাশিয়া বর্তমানে ইউক্রেনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। ইউক্রেন এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা এই আক্রমণকে সাম্রাজ্যবাদী ধাঁচের ভূমি দখল হিসেবে বর্ণনা করেছে। এছাড়া গত কয়েক সপ্তাহে রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনে আবারো আক্রমণ শুরু করেছে। লোকবল হারালেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়েছে।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী অনুযায়ী, দোনেৎস্কের পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রগতির কেন্দ্রবিন্দু বাখমুত এবং আভদিভকা শহরে ক্রমাগত ভারি গোলাবর্ষণ এবং লড়াই হয়েছে।
ইউক্রেনের সামরিক বিশ্লেষক ওলেহ ঝদানভ একটি ইউটিউব ভিডিওতে মন্তব্য করে বলেছেন, 'আভদিভকায় রাশিয়ান বাহিনী তাদেরকে এক দিকে ঠেলে দেওয়ার স্ট্র্যাটেজি সাজিয়েছিল, তবে তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছে এবং এরপর অন্য জায়গায থেকে এগোনোর চেষ্টা করার জন্য লোকবল বাড়াচ্ছে।"
"এটা সম্ভব হয়েছে কেবল রাশিয়ার বিশাল সংখ্যক সৈন্যের কারণে। তারা তাদের ক্ষতির দিকে তেমন মনোযোগ দেয় না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করা, এটি করতে গিয়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে তার দিকে তেমন নজর নেই তাদের।"
সূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা