ওয়াসার পানি সংকটে বিপর্যস্ত রাজধানীর ইব্রাহিমপুর, এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন বাসিন্দারা

দীর্ঘদিন ধীরে পানির সংকটে ভুগছেন রাজধানীর ইব্রাহিমপুর এলাকার বাসিন্দারা। অনেকেই এই সংকটের কারণে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। সপ্তাহজুড়ে কলের পানি না থাকায় পরিবারগুলোকে বোতলজাত পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে; রাতের বেলায় ওয়াসার পানি পাওয়া গেলেও তার পরিমাণ থাকে সীমিত।
শুধু কামাল খান রোডেই—যেখানে ৫০টির বেশি আবাসিক ভবন রয়েছে—গত দুই মাসে অন্তত ১৫টি পরিবার পানি সংকটের কারণে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। এই এলাকার অর্ধেকেরও বেশি ভবনে এখন ঝুলছে 'টু-লেট' সাইন। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি সংকট তাদের দৈনন্দিন জীবনকে 'অসহনীয়' করে তুলেছে।
সিরাজুল ইসলাম নামে এক বাসিন্দা বলেন, "প্রায় পাঁচ বছর এই এলাকায় ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে চলে যেতে হয়েছে। রান্না ও গোসলের জন্যও বোতলজাত পানি কিনতে হতো। এত তীব্র সংকটে আর থাকা সম্ভব হচ্ছিল না।"
বাসিন্দারা জানান, এই সংকট শুধু কামাল খান রোডেই নয়; আশপাশের পুলপার, হাবিবুল্লাহ রোড, গেদা মাদবর রোড, সোনালী ব্যাংক রোড, ঈদগাহ রোড ও ইব্রাহিমপুর বাজার এলাকাও রয়েছে।
রাতে কয়েক ঘণ্টার জন্যই পানি পাওয়া যায়। পুলপারের বাসিন্দা হ্যাপি আক্তার বলেন, "গত পাঁচ দিন ধরে নিয়মিত পানি আসছে না। প্রায় মধ্যরাতের পর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত পানি থাকে। সারাদিনের জন্য আমাদের তখনই পানি মজুত করে রাখতে হয়।"
অন্যরা জানান, পানি সংকটে পড়ে শিক্ষাকার্যক্রমও ব্যাহত হচ্ছে। দারুল কোরআন ক্যাডেট মাদরাসার আব্দুর রহিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত দুই মাস ধরে বিকেলের ক্লাস বন্ধ রাখতে হয়েছে। এখন আরও এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
বাড়ির কেয়ারটেকার ও মালিকরা জানান, ভাড়াটিয়ারা একসঙ্গে এলাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কামাল খান রোডের বাসিন্দা ফজলুল হক বলেন, "অন্তত ১২টি পরিবার ইতোমধ্যে চলে গেছে। বাধ্য হয়ে আমরা একটি গভীর নলকূপ বসিয়েছি। পানি বিলও বেড়ে মাসে এক হাজার টাকায় পৌঁছেছে।"
সড়ক খোঁড়াখুঁড়িতে সংকট আরও তীব্র
কামাল খান রোডের বাসিন্দারা মারাত্মক পানি সংকটে ভুগছেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পানি সরবরাহকারী ট্রাকও ওই এলাকায় প্রবেশ করতে পারছে না।
লিজা বেগম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে গত দুই মাস ধরে ঢাকা ওয়াসার ট্রাক এখানে ঢুকতে পারছে না। এতে সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে।"
এক শ্রমিক জানান, বৃষ্টিসহ নানা জটিলতায় কাজে বিলম্ব হয়েছে। ফলে অনেক বাসিন্দা ঝুঁকি নিয়ে অসম্পূর্ণ সড়কেই চলাচল করছেন বা অবৈধ গভীর নলকূপ বসিয়ে গৃহস্থালির পানি চাহিদা পূরণ করছেন।
এক বাড়ির মালিক বলেন, "পানি ছাড়া উপায় ছিল না, তাই গভীর নলকূপ বসাতে হয়েছে। অন্য কোনো সমাধান নেই।"
ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা জানান, ওয়াসা ও বাড়িওয়ালাদের কাছে বারবার অভিযোগ জানিয়েও কোনো সমাধান মেলেনি। তাদের বলছেন, দ্রুত সমাধান না হলে ভাড়াটিয়াদের এলাকা ছেড়ে যাওয়া চলতেই থাকবে।
বাড়ির মালিক মাহমুদ ইসলাম বলেন, "কখন বাকি ভাড়াটিয়ারাও চলে যাবে, সেই দুশ্চিন্তায় আছি। ইতোমধ্যে আশপাশের ভবনের ৪টি পরিবার গত এক মাসেই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।"
ওয়াসা কী বলছে?
সংকটের কথা স্বীকার করে ঢাকা ওয়াসা (ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ) জানিয়েছে, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়াই এ সংকটের মূল কারণ।
সংস্থাটির নির্বাহী প্রকৌশলী (এমওডিএস জোন-১০) মো. এরশাদুল হক বলেন, ইব্রাহিমপুর এলাকায় প্রায় ১০ হাজার হোল্ডিং রয়েছে, যেখানে কয়েক হাজার পরিবার বসবাস করে। তাদের অধিকাংশই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, "এলাকার জনসংখ্যা দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে নেমে গেছে। ফলে পাম্পগুলো চাহিদা মেটাতে পারছে না।"
তিনি আরও জানান, এলাকায় চারটি পাম্প স্টেশন রয়েছে এবং প্রতিটিতে দুটি করে পাম্প চলছে। কিন্তু ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই এ পানি সংকট সমাধান করা সম্ভব হয়নি।
ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) প্রকৌশলী একেএম শহীদ উদ্দিন জানান, ঢাকার মধ্যে ইব্রাহিমপুরের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সবচেয়ে নিচে, যা বর্তমানে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৯৮ মিটার গভীরে নেমে গেছে।
তিনি বলেন, "সংকট কিছুটা লাঘব করতে আমরা গন্ধবপুর পানি শোধনাগার থেকে সরবরাহ দিচ্ছি।"
কর্তৃপক্ষ জানায়, দীর্ঘদিন ধরে অনুমতি না পাওয়ায় বন্ধ থাকা পাইপলাইন সংযোগের কাজ এখন এগোচ্ছে। তবে স্থায়ী সমাধানে আরও এক থেকে দুই বছর সময় লাগবে বলে জানান তারা। এর জন্য নতুন পাম্প স্থাপন এবং ভূ-পৃষ্ঠের পানি সরবরাহ লাইন সম্প্রসারণ প্রয়োজন হবে।