চুপিসারে ইউরোপের কাছে রাশিয়া থেকে কেনা বাড়তি এলএনজি বিক্রি করছে চীন

মাসখানেক আগেই জানা গিয়েছিল আবাসন বিপর্যয় ও অর্থনীতির শ্লথগতির মধ্যেও রাশিয়া থেকে দেদার প্রাকৃতিক গ্যাস কিনছে চীন। চলতি বছর রাশিয়া থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস কেনা বাড়িয়েছে বেইজিং, অন্যান্য উৎস থেকে এই জ্বালানি আমদানি কমিয়েছে।
গত জুলাইয়ে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চীনের কাস্টমসের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে চীন ২.১৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে মোট ২.৩৫ মিলিয়ন টন তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনেছে রাশিয়া থেকে।
বেইজিংয়ে আমদানির পরিমাণ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৮.৭ শতাংশ বেড়েছে, মূল্য বেড়েছে ১৮২ শতাংশ।
এর অর্থ, ইন্দোনেশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে এ বছর এখন পর্যন্ত চীনের চতুর্থ বৃহত্তম এলএনজি সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে রাশিয়া।
একে পাইপলাইন গ্যাসের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। রুশ উৎপাদনকারী গ্যাজপ্রম সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে পাওয়ার অভ সাইবেরিয়া পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে তাদের দৈনিক সরবরাহ সর্বকালের রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
উল্লেখ্য, তুর্কমেনিস্তানের পর রাশিয়া চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাইপলাইন প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী। এর আগে গ্যাজপ্রম জানিয়েছিল, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে চীনে তাদের গ্যাস সরবরাহ বেড়েছে ৬৩.৪ শতাংশ। বিশেষ করে জুলাই মাসে চুক্তির চেয়েও প্রতিদিন বেশি গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে।
চীনে রুশ এলএনজি সরবরাহে এরকম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার নেপথ্য কারণ কী?
তাছাড়া চীন যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করে, তার অর্ধেকেরও বেশি আমদানি করে থাকে। আর মোট আমদানির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই এলএনজি আকারে আমদানি করে।
অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের গতি ধীর হয়ে যাওয়া ও ব্যাপক শাটডাউনের মধ্যে এ বছর চীনে গ্যাসের চাহিদা তীব্রভাবে কমে গেছে।
তাই প্রশ্ন উঠে যায়, দেশে যখন চাহিদা নেই, তখন চীন কেন রাশিয়ার এলএনজি আমদানি এভাবে অস্বাভাবিক বেড়ে গেল?
অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজের চায়না এনার্জি প্রোগ্রামের পরিচালক মিশাল মেইডান বলেন, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার কারণে কিংবা জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় চাহিদা কমে যাওয়ার কারণেই সম্ভবত চীনে রুশ এলএনজি সরবরাহে বড় উল্লম্ফন হয়েছে।
একটি বিষয় স্পষ্ট—রাশিয়ার সঙ্গে গ্যাসের লেনদেন যতটা সম্ভব ধোঁয়াশার মধ্যে রাখতে চেয়েছিল চীন। এ কারণেই চীনের কাস্টমসের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বছরের শুরু থেকে পাইপলাইপের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির পরিমাণ প্রকাশ্যে জানানো বন্ধ করে দিয়েছে। যদিও চীনের মুখপাত্র লি কুইওয়েন নিশ্চিত করেছেন, এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে 'সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের বৈধ ব্যবসার অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য'।
কিন্তু এখন এই ঢাকঢাক গুড়গুড়ের কারণ সবাই জেনে গেছে। চীন চুপিসারে রুশ এলএনজি এমন এক জায়গায় বিক্রি করছে, যেখানে জ্বালানিটির জন্য হাহাকার পড়ে গেছে।
রাশিয়া থেকে এলএনজি কিনে তা ফের চড়া দামে ইউরোপে বিক্রি করছে চীন।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়:
'শীতকালে ইউরোপের গ্যাসের ঘাটতির শঙ্কা কেটে যেতে পারে এক অপ্রত্যাশিত ত্রাতার কল্যাণে—চীন।
'তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশ্বের বৃহত্তম ক্রেতা চীনে জ্বালানির চাহিদা কম হওয়ায় দেশটি তার কিছু উদ্বৃত্ত এলএনজি কার্গো রিসেল করছে। চীন স্পট মার্কেটে পর্যাপ্ত এলএনজি সরবরাহ করছে, আর চড়া দামে হলেও ইউরোপ তা কিনে নিচ্ছে।
'ফলে ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপের এলএনজি আমদানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা কেপলার। ইউরোপের ব্লক যে ৫৩ মিলিয়ন টন এলএনজি কিনেছে, তা চীন ও জাপানের আমদানিকে ছাড়িয়ে গেছে।'
এভাবে চলতে থাকলে নভেম্বরের মধ্যে ইউরোপ তার গ্যাসের মজুদাগারের ৮০ শতাংশ পূর্ণ করার নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে।
এফটি যে ব্যাপারটি উল্লেখ করেনি, তা হলো চীন 'উদ্বৃত্ত' গ্যাস বিক্রি করেনি। বরঞ্চ রাশিয়া থেকে এলএনজি কিনে তা ইউরোপের কাছে বিক্রি করেছে।
যাহোক, ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপের এলএনজি আমদানি আগের বছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে গবেষণা সংস্থা কেপলারের।
এছাড়া চীনের অন্যতম এলএনজি ব্যবসায়ী জোভো গ্রুপ সম্প্রতি জানিয়েছে যে তারা এক ইউরোপীয় ক্রেতার কাছে একটি এলএনজি কার্গো রিসেল করেছে।
সাংহাইয়ের একজন ফিউচারস ব্যবসায়ী নিক্কেইকে বলেছেন যে এই ধরনের লেনদেন থেকে কয়েক মিলিয়ন, এমনকি ১০০ মিলিয়নে ডলারও লাভ করে থাকতে পারে কেউ কেউ।
চীনের বৃহত্তম তেল পরিশোধনকারী সিনোপেক গ্রুপ এপ্রিল মাসে স্বীকার করেছে যে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে অতিরিক্ত এলএনজি সরবরাহ করছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সিনোপেক একাই ১৫ কার্গো বা প্রায় ৩.১৫ মিলিয়ন টন এলএনজি বিক্রি করেছে। চীনে মোট ৪ মিলিয়ন টনেরও বেশি এলএনজি রাশিয়া থেকে কিনে ফের বিক্রি করেছে। যা জুনের শেষের বছরের প্রথমার্ধে ইউরোপের গ্যাস আমদানির ৭ শতাংশের সমতুল্য।
এই 'অতিরিক্ত' এলএনজির পুরোটাই কিংবা অনেকটাই এসেছে রাশিয়া থেকে। কিন্তু যেহেতু চীন কিনে নিয়েছে, তাই এই গ্যাস আর রাশিয়ান থাকেনি; হয়ে গেছে চীনা এলএনজি।
চীনের অর্থনীতির শ্লথগতি ইউরোপকে স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু চীনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি ফেরার সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাবে এবং বেইজিং আর রাশিয়া থেকে কিনে ইউরোপে এলএনজি রপ্তানি করবে না।
এর অর্থ হলো, গ্যাসের জন্য ইউরোপ এখন রাশিয়ার বদলে বেইজিংয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে।
আর সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হল, ইউরোপকে চীনের ট্যাগ লাগানো এই রাশিয়ান এলএনজি কিনতে হচ্ছে দ্বিগুণ, তিনগুণ কিংবা তারচেয়েও বেশি দামে। অর্থাৎ ইউরোপ শি জিনপিং ও ভ্লাদিমির পুতিন উভয়কেই বাড়তি টাকা দিচ্ছে।
- সূত্র: অয়েলপ্রাইস