দিয়াবাড়ি লেক: ঢাকার বুকেই কায়াকিং
ঢাকা শহরের যান্ত্রিকতা আর ট্রাফিকের ক্যাকোফোনি থেকে খানিকটা দূরে উত্তরার দিয়াবাড়ি লেক যেন এক টুকরো প্রশান্তির নাম। সবুজে ঘেরা আর অদ্ভুত নীরবতায় ভরা এই লেকে আছে কায়াকিং-এর সুযোগ। এখানে জলের বুকে ভেসে থাকা রঙিন কায়াকের বৈঠা শুধু স্রোত নয়, শহরবাসীর ক্লান্তি আর একঘেয়েমিকেও ভাসিয়ে নিয়ে যায় বহুদূরে। যেন মনে হয়, শহরবাসী চিৎকার করে বলছে, 'দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর।'
ব্যস্ত জীবনে খানিকটা স্বস্তির আশায় এখন আর সুদূর কাপ্তাই লেকে ছুটতে হয় না, কিংবা প্রচুর অর্থ খরচও করতে হয় না। ঢাকার ভেতরেই নামমাত্র খরচে মিলছে কায়াকিং-এর সুযোগ। মেট্রোরেলে চড়ে পৌঁছে যেতে পারেন উত্তরা সেন্টার মেট্রো স্টেশনে, সেখান থেকে হাঁটাপথেই লেক। গেলেই যেন মনে হয় টাইম ট্রাভেল করে পৌঁছে গেছেন সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী সিনেমার বিখ্যাত সেই দৃশ্যে—সাদা স্নিগ্ধ কাশফুলের সারি, পেছনে মেট্রোরেল, আর একপাশে দিয়াবাড়ি লেক।
স্থানীয় বাসিন্দা ও কায়াকিং স্পটের প্রধান কর্মকর্তা হোসেন আলী জানান, এই জায়গাটি একসময় পরিচিত ছিল 'কৈলার বিল' নামে। পরে বিলের ধারে বসতি গড়ে ওঠার পর নাম হয় দিয়াবাড়ি। স্থানীয়দের কাছে এটি '৭৩ নম্বর প্লট' নামেও পরিচিত।

আজকের শহুরে প্রজন্মের কাছে বিস্তৃত মাঠ, খোলা আকাশ আর জলের কলকল ধ্বনি অধরাই হয়ে গেছে ভিডিও গেমস, রিলস আর ফোনের আসক্তিতে। সেখানে দিয়াবাড়ি লেক যেন শহরের বুকের ভেতর একটুখানি মফস্বলের ছোঁয়া। বন্ধুবান্ধবের আড্ডা, পারিবারিক অবসর কিংবা প্রিয়জনের সঙ্গে নিরিবিলি সময় কাটাতে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এখানকার কায়াকিং। শুধু তাই নয়, নিশ্চিন্ত ভ্রমণের জন্য আছে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা।
লেকে কায়াকিং করার সময় কিংবা লেক পাড়ে কোনো দুর্ঘটনা, অসুস্থতা কিংবা মোবাইল পড়ে যাওয়ার মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হন উদ্ধারকর্মীরা। এখানে চব্বিশ ঘন্টা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেন প্রায় ২৪ জন কর্মচারী, যাদের তদারকির দায়িত্বে আছেন আরও ছয়জন। আর এই সবকিছু দেখভালের মূল দায়িত্ব পালন করছেন হোসেন আলী।
তার মতে, ধনী-গরিব নির্বিশেষে ঢাকার সব শ্রেণির মানুষ এখানে আসেন। কারণ রাজধানীতে এমন খোলামেলা, নিরিবিলি আর প্রশস্ত জায়গা পাওয়া সত্যিই দুর্লভ। চারপাশের সবুজ, মাথার উপর খোলা আকাশ, হিমেল বাতাস আর লেকের স্রোত—সব মিলিয়ে এটি শহুরে ক্লান্তি মুছে দেওয়ার এক অব্যর্থ ওষুধ। কারও কাছে এটি সপ্তাহান্তের অবকাশ, কারও কাছে আবার নিঃশ্বাস নেওয়ার অবসর।
হোসেন আলী বলেন, 'আমাদের এখানে খুব কঠিন নিয়ম। কোনো পর্যটকের সঙ্গে সামান্যতম অসদাচরণ করলেই কর্মীর চাকরি চলে যায়।'
দায়িত্বশীলতার প্রসঙ্গ টানতে তিনি নিজের জীবনের একটি অভিজ্ঞতা শোনালেন। একবার এক নারী পর্যটকের সাড়ে চার লক্ষ টাকার স্বর্ণের গয়না পানিতে পড়ে যায়। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে আসা সেই নারী বিষয়টি কর্মীদের জানান। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাৎক্ষণিকভাবে কিছুই মেলেনি। তবে হোসেন আলী থেমে যাননি। প্রতিদিন সুযোগ পেলেই খুঁজতে থাকেন। প্রায় ১৩ দিন পর পানির নিচ থেকে স্বর্ণটি উদ্ধার করতে সক্ষম হন। পরে নিজ হাতে মালিকের বাড়িতে পৌঁছে দেন সেটি।
এই ঘটনায় মালিকপক্ষ নাকি বেশ অবাকই হয়েছিলেন। হওয়ারই কথা! প্রায় সপ্তাহ দুই আগের হারানো জিনিস যে আবার ফিরে পাওয়া যাবে, তা কল্পনা করে কে! তারাও করেনি। মূল্যবান জিনিস ফেরত পাওয়া দম্পতি সেদিন প্রশংসায় ভরিয়ে দেন হোসেন আলীকে। যদিও তিনি মনে করেন, 'এটা ছিল দায়িত্ববোধের জায়গা, কাজের অংশ। তার মতে সবাই এমনটা হলে মানুষের আস্থাও বাড়ে।'
তার ভাষায়, 'মানুষ এখানে আনন্দ করতে আসে। তাদের নিরাপত্তা আর জিনিসপত্রের দায়িত্ব আমাদের।'

ফলে নানা শ্রেণি, পেশা, আয়ের মানুষ প্রতিদিন ভিড় জমায় লেকে। ছুটির দিনে ভিড় আরও বাড়ে, কায়াকিং বোট নিয়ে হিমশিম খান কর্মীরা। লম্বা লাইন, খুচরো টাকার ঝামেলা সামলেও দ্রুত টোকেন দিতে হয় তাদের, কারণ কাউকেই তারা বঞ্চিত করতে চান না।
এমনই একজন পর্যটক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার। প্রায়ই শেষ বিকেলের দিকে তিনি এখানে আসেন। কখনো বন্ধুদের নিয়ে, কখনো পরিবারের সঙ্গে। উত্তরাতেই থাকেন বলে আসা-যাওয়া সহজ। মন খারাপের দিনে বৈঠা হাতে কায়াকে উঠলেই মন ভালো হয়ে যায় তার।
'ঢাকায় এরকম জায়গা খুব কম আছে। বাতাসটা নির্মল, একদম অন্যরকম। ঠান্ডা ঠান্ডা মৃদু বাতাসে নৌকায় ভেসে বেড়াতে সবারই ভালো লাগবে। বিশেষ করে আমার ছোট ভাইটা কায়াকিং করতে খুব ভালোবাসে,' বলেন আয়েশা।
এখানে খরচও বেশ সাশ্রয়ী। ৩০ মিনিট কায়াকিং করতে হলে জন প্রতি খরচ হবে ১০০ টাকা মাত্র। একটি নৌকায় সর্বোচ্চ তিনজন বসতে পারেন; ভাড়া পড়বে ৩০০ টাকা। সময় বাড়িয়ে এক ঘণ্টা হলে দিতে হবে ৬০০ টাকা। তবে এক নৌকায় একজন উঠলে তাকে দুজনের ভাড়া দিতে হয়। অর্থাৎ দুজনের জন্য যে ভাড়া দিতে হতো একজনের বেলায়ও তাই।
কেন এমন নিয়ম? হোসেন আলীর ভাষায়, 'একজন যাত্রী নিলে লোকসান হয়। লাভ ওঠে না বলেই এ সিদ্ধান্ত।'
তিনি আরও জানান, কায়াকিং সাধারণত শুরু হয় বিকেল ৩টা থেকে। সকালে সুযোগ থাকলেও তেমন ভিড় হয় না। ফলে গ্রাহকের জন্য দিনের অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হয় তাদের। মূলত বিকেলেই বাড়ে মানুষের আনাগোনা। তবে কায়াকিং চলে নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী—দিনে মাত্র ২ থেকে ৩ ঘণ্টা। কম সময়েও ভিড় বেশি হলে লোকসানের ঝুঁকি থাকে না।

এভাবেই মেট্রোরেলকে ঘিরে দিয়াবাড়ি লেক এখন এক কায়াকিং ট্যুরিস্ট স্পট। লেকের একপাশে বাচ্চাদের রাইড, বেলুন শ্যুটিং, খাবার আর গানবাজনা আর হইচই। অন্যপাশে জলের গান আর পাখির কিচিরমিচির। পড়ন্ত বিকেলে যখন পাখিরা ব্যস্ততায় ঘরে ফেরে, দিনের আলো মিইয়ে আসে, তখন শান্তির খোঁজে মানুষ কায়াকিং করতে আসে। কেউ একা, কেউ বা সঙ্গী নিয়ে। জীবনের বৈঠা বইতে বইতে যারা ক্লান্ত, তারাও এখানে এসে খুঁজে নেন নির্মল আনন্দের টুকরো সময়।
অল্প খরচে, স্বল্প সময়ে ঢাকার মধ্যেই প্রশান্তি খুঁজে পেতে শহরবাসীর কাছে যেন লটারির টিকিট হয়ে উঠেছে দিয়াবাড়ির কায়াকিং।