বাড়িতে বসেই ল্যাব টেস্ট: যেভাবে ‘আমার ল্যাব’ হয়ে উঠলো দেশের স্বাস্থ্য সেবাখাতের প্রথম ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস

টানা চার দিন প্রচণ্ড জ্বর ও শরীরব্যথায় নিদারুণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন আকলিমা আক্তার। পেশায় তিনি একজন শিক্ষিকা। ছেলে-মেয়েরা থাকেন বিদেশে। ঢাকার বাসায় বলতে গেলে তিনি আর তার স্বামীই আছেন। অসুস্থতার এই সময়টায় দুজনই বেশ অসহায় হয়ে পড়েন।
এমন কঠিন সময়ে এক ডাক্তার বন্ধু আকলিমাকে কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে পরামর্শ দেন। কিন্তু শরীরের অবস্থা এতটাই নাজুক হয়ে পড়েছিল যে, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে টেস্ট করানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না তার পক্ষে।
উপায় না দেখে কী করা যায়—তা জানতে অনেকের কাছ থেকেই পরামর্শ নিচ্ছিলেন তিনি। ঠিক তখনই এক সহকর্মীর কাছ থেকে জানতে পারেন 'আমার ল্যাব' নামের একটি প্রতিষ্ঠানের কথা।
বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবা
এই প্রতিষ্ঠানে ফোন করে কী পরীক্ষা করাতে হবে এবং কোন ঠিকানায় তা করতে হবে—এসব জানিয়ে বুকিং দিলেই দ্রুত সময়ে একজন কর্মী বাসায় এসে নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে যান। পরীক্ষার খরচ ব্যতীত সেবা দিতে আসা কর্মীকে দিতে হয় ২০০ টাকা ফি।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নমুনা নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যায় ফলাফল। মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ কিংবা মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সেটি। এমনকি প্রয়োজনে প্রিন্টেড কপিও পৌঁছে দেওয়া হয় গ্রাহকের হাতে।
আকলিমা আক্তারের মতো অনেক বয়স্ক মানুষই এই সেবা নিয়ে বেশ উপকৃত হচ্ছেন। তাদের ইতিবাচক প্রতিক্রিয়ার দেখা মেলে 'আমার ল্যাব' ফেসবুক পেইজের কমেন্টে। কেবল তারাই নয়, হাজার হাজার মানুষের ভরসার জায়গা হয়ে উঠছে এটি।
গর্ভবতী নারীদের পছন্দের তালিকায়ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে এই ল্যাবের সেবা।
যার হাত ধরে শুরু, যেভাবে শুরু
'আমার ল্যাব'-এর মূল কাজই হলো গ্রাহকের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ল্যাব টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা এবং দ্রুত সময়ে ফলাফল পৌঁছে দেওয়া।
বিশেষ করে ব্যস্ত নগরী ঢাকায় বয়স্ক, অসুস্থ বা একা থাকা মানুষদের জন্য এটি একটি বড় সহায়ক সেবা হয়ে উঠছে।
অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানের শুরুটাও হয়েছিল আকলিমার মতো এমনই এক বৃদ্ধ মায়ের অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে।
আর যার হাত ধরে শুরু, তিনি তাজীন শাদীদ—একজন সফটওয়্যার প্রকৌশলী। দেশে উচ্চমাধ্যমিক পাসের পর পাড়ি জমিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। নর্থ টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

২০০৫ সালে যোগ দেন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফটে। কাজ করতেন যোগাযোগ ও পণ্য উদ্ভাবন নিয়ে। সবকিছু তার স্বপ্নের মতোই ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু তারপরই আসে জীবনের কঠিনতম মুহূর্ত। ২০০৭ সালে মায়ের শরীরে ধরা পড়ে ক্যানসার। তখন তিনি মাইক্রোসফটে কর্মরত।
সে সময়ে মায়ের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার জন্য বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার জটিলতা সামলাতে তাকে ভীষণ বেগ পেতে হয়। চিকিৎসার জন্য মায়ের এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি আর ঝামেলা-ঝক্কি তাকে বেশ চিন্তিত করে তোলে।
যদিও তার মা বেঁচে যান, তবে এই অভিজ্ঞতা তাজীনের মনে গভীর ছাপ ফেলে। মূলত এই ঘটনা থেকেই দেশে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার সংকল্পের জন্ম হয় তার মনে।
সহজ, সাশ্রয়ী ও ভোগান্তিহীন স্বাস্থ্যসেবা
বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য তাজীনের চিন্তার জায়গাটা ছিল বেশি। তার ভাবনা ছিল—যদি তার মায়েরই চিকিৎসা পেতে এত ঝামেলা পোহাতে হয়, তাহলে যারা অসহায়, দরিদ্র, তাদের হয়তো আরও বেশি ভোগান্তির ভেতর দিয়ে দিন কাটাতে হয়।
এত দুর্ভোগের পর সুচিকিৎসা কজন পান—সেটাও বলা কঠিন।
এই ভাবনার পরিপ্রেক্ষিতেই হেলথ কেয়ার নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্যে তাজীন গড়ে তোলেন 'স্পৃহা ফাউন্ডেশন' নামে একটি এনজিও। ছোট্ট এই ফাউন্ডেশন থেকে তিনি ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারী সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করেন।
সময়টা ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাস। ঢাকার মোহাম্মদপুরের এক বস্তিতে ছোট একটি ক্লিনিক দিয়ে শুরু হয় এই স্বপ্নের পথচলা। ক্লিনিকের প্রথম ডাক্তার হিসেবে যুক্ত হন তাজীনের বন্ধু ইশতিয়াক জাহিদ।
তবে সে সময় তাজীন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। দূর থেকেই তিনি তদারকি করতেন ক্লিনিকের সমস্ত কার্যক্রম।
২০১৬ সালের অক্টোবরে মাইক্রোসফটের চাকরি ছেড়ে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
একদিকে 'স্পৃহা' বড় হচ্ছিল, অন্যদিকে তাজীনের স্বপ্নটাও।
পরের বছর, ২০১৭ সালে, দুই তরুণ সঙ্গী—ডা. ইশতিয়াক জাহিদ ও সাব্বির আমিনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন দেশের স্বাস্থ্যখাতের প্রথম ডিজিটাল স্টার্টআপ—'আমার ল্যাব'।
তাদের লক্ষ্য ছিল একটাই—সবার জন্য সহজ, সাশ্রয়ী ও ভোগান্তিহীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা।

সমাধান দেবে টেকনোলজি
তাজীন শাদীদের ভাবনা ছিল পরিষ্কার—টেকনোলজির সহায়তায় এমন একটি সেবা গড়ে তোলা, যা মানুষের বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
আজ সেই স্বপ্নই বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে 'আমার ল্যাব'-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে।
তাজীন বলেন, "হাসপাতালে গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো, বারবার রিপোর্ট আনতে যাওয়া—সবকিছুই ক্লান্তিকর। সময়, টাকা—সবই অপচয় হয়। অথচ প্রযুক্তির সাহায্যে এটা অনেক সহজ করা সম্ভব।"
'আমার ল্যাব' ঠিক সেটাই করছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গ্রাহক নিজেই পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টার বেছে নিতে পারেন।
নিবন্ধনের পর, প্রশিক্ষিত মেডিকেল টেকনোলজিস্ট যান গ্রাহকের বাসা বা অফিসে। সেখানেই সংগ্রহ করেন নমুনা। এরপর পরীক্ষার ফলাফল পৌঁছে যায় গ্রাহকের মুঠোফোনে।
প্রায় ৯২টি ল্যাব পার্টনার রয়েছে তাদের। এর মধ্যে পরিচিত কয়েকটি নাম হলো—পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার (সব শাখা), ইবনে সিনা, ইউনাইটেড হসপিটাল, মেডিনোভা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং বারডেম।
আরও একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, 'আমার ল্যাব' বারডেমের 'এক্সক্লুসিভ প্রোভাইডার'। অর্থাৎ বারডেমের সকল টেস্ট তারা বাসা থেকেই করিয়ে দিতে পারে। এতে খরচ ও সময়—দুটোই সাশ্রয় হয় মানুষের।
প্রতিদিন ৬০০-র বেশি টেস্ট করিয়ে থাকে 'আমার ল্যাব'। এর মধ্যে বেশি হয়ে থাকে ব্লাড সুগার টেস্ট, সিবিসি, ডেঙ্গু, লিপিড প্রোফাইল টেস্ট, ভিটামিন ডি টেস্ট, এইচবিএওয়ানসি, আরবিএস, ইসিজিসহ আরও অনেক স্বাস্থ্যপরীক্ষা।
মোদ্দাকথা—রক্ত, প্রস্রাব, পায়খানা, ইসিজি—সব ধরনের প্যাথলজিক্যাল টেস্ট ঘরে বসেই করানো যায় এই ল্যাবের মাধ্যমে।
ঢাকা-কেন্দ্রিক সেবা
তবে এই সেবা এখন পর্যন্ত কেবল ঢাকাকেন্দ্রিক চালু রয়েছে। চট্টগ্রামেও স্বল্প পরিসরে শুরু করার চেষ্টা চলছে।
তাজীনের ইচ্ছে, ভবিষ্যতে সারা বাংলাদেশজুড়ে চালু হবে এই সেবা।
চার বছরের মধ্যেই অর্ধলক্ষের বেশি মানুষ এই সেবা গ্রহণ করেছেন।
তাজীন বলেন, "আমাদের সবচেয়ে বড় স্যাটিসফ্যাকশনের জায়গা হলো—একবার যদি কেউ আমাদের সার্ভিসটা নেন, তবে দেখা যায়, পরবর্তীতেও তারা সেবা নিতে থাকেন। তাদের মধ্যে শতভাগ আস্থা চলে আসে, যখন তারা সেবার মানটা দেখেন। কারণ একবার নিলেই তারা বুঝে যান এটা কতটা সহজ।"
তাছাড়া, গ্রাহকদের কাছ থেকে নয়—মূলত তাদের আয় আসে ল্যাবগুলোর কাছ থেকে। তাই 'আমার ল্যাব'-এ গ্রাহকের কোনো অতিরিক্ত খরচও নেই বলে জানান তাজীন।

সুখকর 'শুরু' ছিল না
তবে বাংলাদেশে এমন একটি ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা চালুর শুরুটা মোটেই সহজ ছিল না।
তাজীন বলেন, "সাধারণ ডেলিভারি হয় দরজার বাইরে। আর আমরা কাজ করি ঘরের ভেতরে। তো সেদিকে লক্ষ্য রেখে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করে মানুষের আস্থা অর্জন করাই ছিল প্রথম চ্যালেঞ্জ।"
২০১৭ সালের দিকে বেশ ছোট পরিসরে শুরু করেছিলেন তাজীন। শুরুর দিকে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি হয়েছিল স্যাম্পল ট্রান্সপোর্ট টেকনোলজি নিয়ে।
"চ্যালেঞ্জ ছিল আসলে একটা স্যাম্পল কীভাবে ট্রান্সপোর্ট করব সেটা নিয়ে। কারণ ওইটার কোনো স্পেসিফিক টেকনোলজি ছিল না। কীভাবে বাসা থেকে একটা স্যাম্পল নিয়ে যাব—আমাদের তো জ্যাম আছে, টেম্পারেচার ইস্যু আছে—এসব মেইনটেইন করে কীভাবে আমরা ল্যাব পর্যন্ত পৌঁছাব। সেটার জন্য আমরা নেদারল্যান্ড সরকারের সঙ্গে একটা জয়েন্ট প্রজেক্ট করে আমাদের কারেন্ট যে স্যাম্পল ট্রান্সপোর্টেশন টেকনোলজি আছে, সেটা শুরু করি," বললেন তাজীন।
বাসায় গিয়ে রক্ত সংগ্রহ করার চ্যালেঞ্জের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, "আমাদের দেশে মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা আছেন যারা, তাদের কেউই বাসায় যেতে অভ্যস্ত ছিলেন না। আমি যখন তাদের সঙ্গে কথা বলি, তখন কেউই সেভাবে সাড়া দেননি। কেউ কেউ তো 'ডেলিভারি ম্যানের কাজ' বলেও ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাকে।"
আস্থা বাড়ে, সঙ্গে গ্রাহকও
তবে তাজীন কোনোভাবেই হাল ছাড়ার মানুষ নন। শুরুর দিকে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও তিনি সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন দ্রুতই।
ধীরে ধীরে মানুষের আস্থাও অর্জন করতে সক্ষম হন তারা। তবে একদিনেই যে তা সম্ভব হয়নি, তা একবাক্যে স্বীকার করলেন তাজীন।
২০১৭ সালে স্বল্প পরিসরে শুরু করলেও ধীরে ধীরে কাজের পরিধি বাড়াতে থাকেন তিনি। বিশেষ করে ২০১৯-২০ সালে, কোভিড-১৯ মহামারির সময় এই সেবার গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
মানুষের আস্থা বাড়ে। সঙ্গে বাড়তে থাকে গ্রাহকের সংখ্যাও।
এই প্রতিষ্ঠানের ফেসবুক পেইজের পাশাপাশি ওয়েবসাইটেও পাওয়া যাবে সকল তথ্য। গ্রাহক যে স্বাস্থ্যপরীক্ষাটি করাতে চান, সেটি উল্লেখ করে ফোন কল বা মেসেজের মাধ্যমে বুকিং দিলেই দ্রুততম সময়ে বাসায় পৌঁছে যাবে সেই সেবা।
তাজীন শাদীদ বলেন, "আমাদের লক্ষ্য ছিল একটাই—কীভাবে সব শ্রেণির মানুষ খুব সহজে স্বাস্থ্যসেবা পেতে পারেন এবং রোগী কীভাবে এসব দৌড়াদৌড়ির ঝামেলা এড়াতে পারেন সেগুলোর সমাধান বের করা।
"আমরা অনেকটাই সফল হয়েছি। সামনের দিনগুলোতে লাখ লাখ মানুষ এই সেবা গ্রহণ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি," যোগ করেন তাজীন।