দেশেই লিভার প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার

লিভার জটিলতায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় দেশেই লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা লিভার প্রতিস্থাপন চালু করার ভাবছে সরকার। প্রাথমিকভাবে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে এ প্রক্রিয়া শুরু করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
এ লক্ষ্যে ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সহযোগিতায় কার্যক্রম শুরু হবে। এসব দেশের বিশেষায়িত হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করবে সরকার।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, "আমরা আপাতত দুই জায়গায় লিভার প্রতিস্থাপন শুরু করতে চাই। বারডেমে ফ্যাসিলিটি আছে, সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। গ্যাস্ট্রোলিভারে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে ৪-৫ মাস লাগবে।"
তিনি আরও বলেন, "বারডেমে আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন শুরু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শুরুতে বিদেশি বিশেষজ্ঞ সার্জনরা উপস্থিত থেকে অপারেশন করবেন এবং দেশি চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেবেন। কয়েকটি কেস তাদের তত্ত্বাবধানে করা হবে। প্রযুক্তি স্থানান্তরের (টেকনোলজি ট্রান্সফার) মাধ্যমে পরবর্তীতে আমাদের চিকিৎসকরাই অপারেশন পরিচালনা করবেন।"
ডা. সায়েদুর রহমান আরও বলেন, "স্ক্রিনিং ও কেস সিলেকশন সঠিক না হলে প্রতিস্থাপন সফল হয় না। অপারেশন থিয়েটার থেকে শুরু করে পোস্ট-অপারেটিভ প্রতিটি ধাপে ইনফেকশন যেন শূন্যে থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে।"
দেশের প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন কার্যক্রমের নেতৃত্ব দেওয়া বারডেম জেনারেল হাসপাতালের হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আলী বলেন, "দক্ষ জনবলের অভাব ও নানা জটিলতার কারণে ২০২০ সালের পর দেশে লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বন্ধ রয়েছে। এখন সরকার উদ্যোগ নিয়েছে আবার শুরু করার। এতে রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রয়োজন কমবে, খরচও বাঁচবে।"
তিনি জানান, দ্রুত কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে একটি টিম গঠনসহ সকল প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে একটি লিভার প্রতিস্থাপনে আনুমানিক খরচ হতে পারে ৩০ লাখ টাকা। বিদেশে যার খরচ ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত। দেশেই কার্যক্রম শুরু হলে অন্তত যারা বিদেশে চিকিৎসা নেন, তারা এখানেই প্রতিস্থাপন করাতে পারবেন।
কাদের লিভার প্রতিস্থাপন দরকার?
অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী জানান, লিভার সিরোসিস, কিছু লিভার ক্যান্সার এবং লিভার ফেলিওরের রোগীদের জন্য লিভার প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। দেশে প্রায় ১ কোটি মানুষ বিভিন্ন ধরনের লিভার রোগে আক্রান্ত, যাদের মধ্যে ১৫-২০ শতাংশের লিভার সিরোসিস হতে পারে।
১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কোনো সুস্থ ব্যক্তি, যার রক্তের গ্রুপ গ্রহীতার সঙ্গে মিলে যায়, তিনি লিভারের একটি অংশ দান করতে পারেন। কঠোর স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে দাতা ও গ্রহীতার শারীরিক উপযুক্ততা নিশ্চিত করা হয়। দানের পর সাধারণত ৬ থেকে ১২ সপ্তাহে দাতার অবশিষ্ট লিভার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইনে নির্ধারিত নিকট আত্মীয়রাই দাতা হতে পারেন, তবে ব্লাড গ্রুপ অবশ্যই এক হতে হবে। সফল প্রতিস্থাপনের পর একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন।
দেশে তিনটি সফল লিভার প্রতিস্থাপন
বারডেমে ১৯৯৯ সালে হেপাটো-বিলিয়ারি-প্যানক্রিয়াটিক সার্জারি চালু হয়। ২০১০ সালের জুনে সেখানে প্রথম লিভার প্রতিস্থাপন সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরেরটি হয় ২০১১ সালের আগস্টে এবং তৃতীয়টি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে। তিনটিতেই নেতৃত্ব দেন ডা. মোহাম্মদ আলী। প্রথম দুটি কেস নিয়ে ২০১৪ সালে আইসিডিডিআর,বি-এর জার্নালে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক
গত ৩ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স রুমে লিভার প্রতিস্থাপন বিষয়ক এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের যেকোনো প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালে সমঝোতা স্মারক সই করবে। পাশাপাশি ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা বাড়াতে আর্থিক সহায়তা দেবে সরকার।
সভায় জানানো হয়, সাধারণ মানুষের সেবার মান নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত চিকিৎসক টিম গঠন জরুরি। এতে বিদেশমুখী চিকিৎসা নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। তিনি বলেন, "গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউটে লিভার প্রতিস্থাপন চালুর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে।"
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান সভায় বলেন, "ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের সঙ্গে প্রশিক্ষণ, মনিটরিং ও স্বাধীনভাবে অপারেশন—এই তিন ধাপে সমঝোতা স্মারক কার্যকর করার মাধ্যমে কার্যক্রম সফলভাবে চালানো সম্ভব। একইসঙ্গে চিকিৎসক টিমের সদস্যদের সার্বক্ষণিক দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করাও জরুরি।"