টিআর-কাবিখার ২,১৬২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে: ত্রাণ উপদেষ্টা

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম বলেছেন, অপচয় রোধে গত বছর টিআর (গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচি) ও কাবিখার (গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার কর্মসূচি) ২১৬২ কোটি টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। আজ বুধবার সচিবালয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দপ্তরে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন।
ত্রাণ উপদেষ্টা বলেন, "২০২৪ সালের ৮ আগস্ট যখন আমরা শপথ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন অর্থবছরের প্রায় তিন মাস অতিবাহিত হয়ে গেছে। ওই সময় আমি টিআর ও কাবিখার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন নিয়ে সারাদেশের প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের তথ্যে জানতে পারলাম, সে মুহূর্তে প্রকল্প দিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তাই টাকাগুলো সরকারকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।"
উপদেষ্টা আরও বলেন, "টিআর ও কাবিখার বিশেষ বরাদ্দ সংকুচিত করায় দুর্নীতি ও অপচয় কমেছে এবং বরাদ্দে আঞ্চলিক সমতা আনা সম্ভব হয়েছে। আগে যেভাবে মন্ত্রণালয় থেকে ঢেউটিন ও কম্বল একসঙ্গে রাজধানীতে ক্রয় করে সারাদেশে পাঠানো হতো, এখন আর তা করা হয় না। ঢেউটিন, শুকনো খাবার ও কম্বল ক্রয় বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় গুদামে সংরক্ষণ ও পরিবহন ব্যয় কমেছে, সময় সাশ্রয় হয়েছে, বিতরণে গতি বেড়েছে এবং তাৎক্ষণিক বিতরণ সম্ভব হচ্ছে।"
এছাড়াও, উপকারভোগী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব, স্বজনপ্রীতি ও দ্বৈততা পরিহার করা হয়েছে এবং পুরোনো তালিকার বদলে নতুন তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, "প্রাকৃতিক, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ও মনুষ্যসৃষ্ট নানা দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাব বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। সেই ভিশন বাস্তবায়নে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে জনগণ, বিশেষ করে দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি হ্রাস এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম একটি দক্ষ জরুরি সাড়াদান ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কাজ করছে মন্ত্রণালয়।"
তিনি আরও বলেন, "মন্ত্রণালয়ের অধীনে উল্লেখযোগ্য দপ্তর হলো দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (সিপিপি) এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়। উপজেলা পর্যায়ের প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগে তাদের কর্মকালে কী কী প্রকল্প গৃহীত হয়েছে সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে প্রকল্প গ্রহণে দ্বৈততা এড়ানো যায়।"
এর পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপের সুযোগ দিতে মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। দুর্যোগকালীন সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষিত সদস্যদের উদ্ধারকাজে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এজন্য ফায়ার সার্ভিস, আনসার ও বিজিবিসহ সব বাহিনীতে দুর্যোগকালীন বিশেষ টিম গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, "আগাম সতর্কবার্তার কারণে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমানো সম্ভব হয়েছে। ফারুক-ই-আজম বলেন, ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে এখনো আগাম সতর্কতা দেওয়া সম্ভব নয়, তবে ভবিষ্যতে এ বিষয়ে প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রচেষ্টা চলছে। উপদেষ্টা বলেন, গত অর্থবছরে ইজিপিপির পাশাপাশি চলমান অন্যান্য প্রকল্পের পরিবীক্ষণ এবং ইজিপিপির উপকারভোগীর হালনাগাদ তালিকা না থাকায় ওই প্রকল্পে বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়।"
তিনি বলেন, "ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান, উদ্ধার অভিযান এবং জরুরি যোগাযোগের জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্পের আওতায় ১৭৬ কোটি টাকার ১১টি এরিয়াল প্ল্যাটফর্ম ল্যাডার ক্রয় করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া, একই প্রকল্পের আওতায় উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে উদ্ধারকাজে ব্যবহারের জন্য সিপিপির প্রশিক্ষিত ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে ৬১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ১৩ ধরনের সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে।"
উপদেষ্টা বলেন, "মন্ত্রণালয়ের সব কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করতে 'সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম উন্নয়ন' শীর্ষক সফটওয়্যার তৈরির টিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। তিনি জানান, বন্যা-প্রবণ ও নদীভাঙন এলাকায় বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় চলতি অর্থবছরে (২০২৫-২৬) ৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ চলছে এবং ২০২৬-২৭ অর্থবছরে আরও ৬৩টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ সম্পন্ন করা হবে।"
তিনি বলেন, "গ্রামীণ রাস্তায় ১৫ মিটার দৈর্ঘ্য পর্যন্ত সেতু/কালভার্ট নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ১০০টি ব্রিজ নির্মাণ কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়া, গ্রামীণ মাটির রাস্তাগুলো টেকসই করতে হেরিং বোন বন্ড (এইচবিবি) করণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি কার্যক্রম চলছে। দুর্যোগ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে ১৪৩টি আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের কাজও চলছে। উপদেষ্টা জানান, জাইকার অর্থায়নে গৃহীত 'ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট (কম্পোনেন্ট-২ ও কম্পোনেন্ট-৩)' এর আওতায় ৫৫টি উদ্ধার নৌকা ক্রয়, ২০টি বক্স কালভার্ট নির্মাণ, ২০ কিলোমিটার প্যালাসাইডিং এবং ৩২ কিলোমিটার এইচবিবি রাস্তা নির্মাণ কার্যক্রম চলছে।"
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির জাতীয় সদর দপ্তর নির্মাণকাজও চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। উপদেষ্টা বলেন, একই প্রকল্পের আওতায় সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে ৩৪০ কোটি টাকার উদ্ধার যন্ত্রপাতি, বাংলাদেশ পুলিশকে ৬৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকার উদ্ধার সরঞ্জাম এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরকে ৫৯ কোটি টাকার উদ্ধার নৌকা দেওয়া হবে। তিনি জানান, চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নির্মাণ (১ম পর্যায়) প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।
তিনি বলেন, "বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে অংশীদারমূলক কার্যক্রমের আওতায় মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা এবং একাডেমিয়ার সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জাতীয় দুর্যোগে জরুরি সাড়াদান কার্যক্রম সমন্বয়ের জন্য চীন সরকারের অনুদানে ঢাকার সাতরাস্তায় সিএসডি গুদাম এলাকায় ন্যাশনাল এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার (এনইওসি) নির্মাণ ও এ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের পরিধি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। নগর দুর্যোগ, বিশেষ করে ভূমিকম্পের ক্ষতি মোকাবিলায় দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ও প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা নেওয়া হবে।"
তিনি আরও বলেন, "বিশ্বব্যাংক ও জাইকার ঋণে চলমান দুটি প্রকল্পের আওতায় যথাক্রমে ৩৭০টি ও ৪৩টি উদ্ধারকারী স্পিডবোট কেনার কাজ চলছে। তবে বন্যাদুর্গত এলাকায় এ ধরনের স্পিডবোট ব্যবহার কঠিন হওয়ায় কেবল উপকূলীয় এলাকায় জাইকার অর্থায়নে অ্যাম্বুলেন্স সুবিধাসহ ১২টি স্পিডবোট কেনা যেতে পারে। প্রকল্পে নির্ধারিত বাকি স্পিডবোটের পরিবর্তে স্থানীয়ভাবে তৈরি দেশি নৌকা কেনার বিষয় বিবেচনা করা হচ্ছে।"
উপদেষ্টা বলেন, "ন্যাশনাল এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের জন্য চাহিদাকৃত জমি নিয়ে জটিলতা আছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটে দুটি আঞ্চলিক ন্যাশনাল এমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার কাম গুদাম এবং ঢাকার বিমানবন্দরের কাছে আধুনিক ত্রাণ গুদাম নির্মাণে চীন সরকারের সহায়তা পেতে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যোগাযোগ করা হলে অর্থায়ন সহজ হতে পারে।"
এছাড়াও তিনি বলেন, "দুর্যোগকালীন জরুরি সাড়াদান ও উদ্ধার কার্যক্রম ব্যবস্থাপনায় প্রধান সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের মতো দপ্তর সহযোগিতা করে, যাদের মূল কাজও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের কার্যপরিধি ও এসব দপ্তরের কার্যপরিধি ভিন্ন হওয়ায় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে ঘাটতি তৈরি হয়। তাই এসব দপ্তরকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে আনা অধিকতর যৌক্তিক হবে বলে আমরা মনে করি।"
উপদেষ্টা জানান, ইজিপিপির আওতায় উপকারভোগীর মজুরি পরিশোধের ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি আরও জানান, মন্ত্রণালয়ের চলমান নানা প্রকল্পে যেমন রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট ও বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের মতো অবকাঠামো নির্মাণ কাজ আছে। এগুলো সরকারের প্রকৌশল বিভাগ সংশ্লিষ্ট হওয়ায় ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যক্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে না রাখাই যৌক্তিক হবে বলে মনে করেন তিনি।