বলিউডকে প্রথম ব্লকবাস্টার হিট দিয়েছিলেন এই বাঙালি তারকা, ৩২ বছর পর সেই রেকর্ড ভাঙে ‘শোলে’

তারকাখ্যাতির আলোয় আসার আগে অশোক কুমারের জীবনটা সিনেমার নায়কদের মতো ছিল না। কুমুদলাল গাঙ্গুলী নামে জন্ম নেওয়া অশোক ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত বাঙালি পরিবারের ছেলে। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলী ছিলেন ডাকসাইটে আইনজীবী এবং স্বপ্ন দেখতেন ছেলেও তার পেশা বেছে নেবে। অশোক কুমার নিজেও আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ভাগ্য তার জন্য লিখে রেখেছিল এক অন্য অধ্যায়।
আইন পরীক্ষার প্রথম ধাপেই হোঁচট খাওয়ার পর হতাশ অশোক ঠিক করলেন, নতুন করে জীবন শুরু করবেন। ভাগ্যান্বেষণে পাড়ি জমালেন মুম্বাইয়ে, তখনও তিনি ঘুণাক্ষরেও জানতেন না যে এই শহরই তাকে একদিন ভারতের রুপালি পর্দার কিংবদন্তি বানিয়ে তুলবে।
ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে সিনেমার নায়ক
অশোক কুমারের চলচ্চিত্রে প্রবেশটা যেন সিনেমারই এক নাটকীয় দৃশ্য! তিনি তৎকালীন অন্যতম জনপ্রিয় স্টুডিও 'বোম্বে টকিজ'-এ ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালে 'জীবন নাইয়া' ছবির শুটিং চলাকালীন ভাগ্য যেন তার জন্য এক দারুণ চিত্রনাট্য লিখে ফেলল।

ছবির প্রধান অভিনেতা নাজমুল হাসান হঠাৎ করেই বেঁকে বসলেন, কাজ ছেড়ে দিলেন। তখন বোম্বে টকিজের প্রতিষ্ঠাতা হিমাংশু রায় নিলেন এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত। তিনি ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট অশোক কুমারকেই ছবির নায়ক হিসেবে বেছে নিলেন! পরিচালক ফ্রাঞ্জ ওস্টেন তো কিছুতেই রাজি নন, কারণ তার মতে অশোকের মধ্যে প্রচলিত 'হিরোসুলভ' কিছুই ছিল না। কিন্তু হিমাংশু রায় ছিলেন নাছোড়বান্দা, তিনি অশোক কুমারকেই ক্যামেরার সামনে ঠেলে দিলেন।
আর তখনই কুমুদলাল গাঙ্গুলী হয়ে গেলেন অশোক কুমার—জন্ম হলো এক নতুন তারকার। 'জীবন নাইয়া' বক্স অফিসে দারুণ সফল হলো এবং এর সাথেই শুরু হলো এমন এক অভিনেতার উত্থান, যিনি ভারতীয় চলচ্চিত্রের অভিনয়ের চিত্রটাই বদলে দিয়েছিলেন।
বলিউডে তিনি কেন 'গেম-চেঞ্জার' ছিলেন?
যে যুগে সিনেমার পর্দায় মঞ্চ-নাটকের মতো উচ্চকিত অভিনয়ের রমরমা ছিল, সেই সময়ে অশোক কুমারের অভিনয় ছিল যেন এক ঝলক তাজা হাওয়া—সতেজ এবং একেবারে বাস্তব। তার সরলতা, সাবলীল সংলাপ আর পাশের বাড়ির ছেলের মতো অভিব্যক্তি দর্শকদের হৃদয়ে সঙ্গে সঙ্গে জায়গা করে নিত।

তিনি 'অচ্ছুৎ কন্যা', 'হাওড়া ব্রিজ', 'কিসমত', 'বন্দিনী', 'ঝুলা' এবং 'চলতি কা নাম গাড়ি'-র মতো একের পর এক কালজয়ী ছবিতে অভিনয় করেছেন। বিশেষ করে মীনা কুমারীর সঙ্গে তার জুটি ছিল অনবদ্য, তারা দুজনে মিলে হিন্দি সিনেমার কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত তৈরি করেছিলেন।
১৯৪৩ সালে তার 'কিসমত' ছবিটি রীতিমতো ইতিহাস গড়ে ফেলে। সেই সময়ে নায়কদের জন্য যা ছিল অকল্পনীয়, সেই রকম একটি নৈতিকভাবে ধূসর বা 'গ্রে' চরিত্রে অভিনয় করে অশোক কুমার সমস্ত প্রথা ভেঙে দেন এবং ভারতীয় দর্শকদের কাছে 'অ্যান্টি-হিরো'র ধারণাটি পরিচিত করান। ছবিটি ব্লকবাস্টার হিট হয়, বছরের পর বছর প্রেক্ষাগৃহে চলে এবং টানা ৩২ বছর ধরে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা ভারতীয় চলচ্চিত্রের রেকর্ড ধরে রাখে। অবশেষে ১৯৭৫ সালে ধর্মেন্দ্র এবং অমিতাভ বচ্চনের 'শোলে' সেই রেকর্ড ভাঙে।

এক কিংবদন্তির উত্তরাধিকার
অশোক কুমার শুধু একজন অভিনেতাই ছিলেন না; তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। দুর্বলতা এবং শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জাদুকরী ক্ষমতা তাকে কালজয়ী করে তুলেছিল। যখন নায়করা নেতিবাচক ভূমিকা এড়িয়ে চলতেন, তখন তিনি সাহসের সঙ্গে সেইসব চরিত্রে অভিনয় করে দেখিয়েছিলেন যে, নায়কের আকর্ষণ আর চরিত্রের নৈতিক জটিলতা একই ফ্রেমে সহাবস্থান করতে পারে।

২০০১ সালে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও, তার অভিনয় এখনও দর্শকদের মনে অমলিন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অভিনেতারা তাকে ভারতীয় সিনেমায় স্বাভাবিক ও বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের ভিত্তি স্থাপনকারী অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।