ভারতীয় ঋণ নিয়ে অচলাবস্থায় বগুড়া-সিরাজগঞ্জ রেল প্রকল্প, বাস্তবায়নে নতুন উদ্যোগ সরকারের
দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা বগুড়া–সিরাজগঞ্জ ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্প বাস্তবায়নে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ভারতের ঋণ থেকে সরে আসার পর এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) প্রকল্পটিতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের নথি অনুযায়ী, সংশোধিত প্রস্তাবে প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা— যা প্রাথমিক ব্যয়ের প্রায় দ্বিগুণ।
প্রকল্পটি প্রথমে ২০১৮ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অনুমোদন দেয়। তখন এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫ হাজার ৫৭৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রকল্পটি ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে বছরের পর বছর প্রকল্পগুলোর তেমন অগ্রগগি ছিল না।
গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ভারতীয় অর্থায়নে থাকা একাধিক প্রকল্প নিয়ে না আগানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যার মধ্যে এই রেল প্রকল্পটিও রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিকল্প অর্থায়নের উৎস খুঁজতে শুরু করেছে। বর্তমানে আলোচনায় থাকা উন্নয়ন অংশীদারদের মধ্যে এআইআইবি প্রাথমিক আগ্রহ দেখিয়েছে, তবে এখনো চূড়ান্ত অনুমোদন মেলেনি।
রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, ভারতের দ্বিতীয় এলওসির আওতায় আগে প্রকল্পটির জন্য ৩৭ কোটি ৯২ লাখ ৯০ হাজার ডলার বরাদ্দ ছিল। বাস্তবায়নে বিলম্ব ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এক্সিম ব্যাংকের কাছে অতিরিক্ত ৩০ কোটি ডলার ঋণের প্রস্তাব দেয়। তবে সে অর্থায়ন বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রকল্প পরিচালক আবু জাফর মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, সরকার প্রকল্পটিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং এটি উত্তরাঞ্চলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উদ্যোগ। তিনি বলেন, অর্থায়ন নিশ্চিত হলেই দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু করা হবে, এতে বাস্তবায়নের গতি বাড়বে। তবে জমির দাম ও নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়েছে।
জাফর মিয়া আরও জানান, প্রকল্পের নকশা ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। ফলে নতুন করে কোনো সমীক্ষার প্রয়োজন নেই এবং এতে কয়েক বছর সময় সাশ্রয় হবে। প্রকল্পের জন্য প্রায় ৯০০ একর জমি প্রয়োজন হবে। জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনগুলোকে ইতোমধ্যে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। রুটের বেশিরভাগ অংশ গ্রিনফিল্ড এলাকা হওয়ায় দ্রুত ভূমি অধিগ্রহণ সম্ভব হবে বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা।
আঞ্চলিক যোগাযোগে বড় পরিবর্তন
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটিকে উত্তরাঞ্চলের রেল যোগাযোগের জন্য একটি 'গেম চেঞ্জার' হিসেবে দেখছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের মধ্যে রেলপথের দূরত্ব ১১৪ কিলোমিটার কমবে এবং যাত্রার সময় সর্বোচ্চ তিন ঘণ্টা পর্যন্ত কমে আসবে। এতে রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও বগুড়ার সঙ্গে দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য রেল যোগাযোগ গড়ে অঠার পাশাপাশি যাত্রী ও পণ্য পরিবহন উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে।
রেল পরিবহন নিরাপদ, সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় নতুন ডুয়েল গেজ লাইনটি উত্তরাঞ্চলে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে এবং উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। উন্নত যাত্রী ও পণ্য পরিবহন সেবার মাধ্যমে সামগ্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সহায়তা মিলবে।
বিকল্প বিদেশি অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ রেলওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) চিঠি দিয়েছে। ইআরডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এআইআইবি প্রাথমিক আগ্রহ দেখিয়েছে এবং তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা করা হবে। পাশাপাশি নমনীয় ঋণ শর্ত দেওয়া অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের সঙ্গেও আলোচনা হতে পারে।
সংশোধিত পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা (প্রায় ৮৫ কোটি ২৯ লাখ ডলার)। এর মধ্যে বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং বাকি অর্থ দেবে সরকার।
প্রকল্পের আওতায় বগুড়া থেকে যমুনা সেতুর পশ্চিম প্রান্তের সয়দাবাদ পর্যন্ত ৮৫ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার ডুয়েল গেজ মূল রেললাইন এবং ৩৭ দশমিক ৪৯ কিলোমিটার লুপ লাইন নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি প্রায় ৯০০ একর জমি অধিগ্রহণ, আটটি নতুন স্টেশন নির্মাণ, তিনটি বিদ্যমান স্টেশনকে জংশনে রূপান্তর, ২১২টি সেতু নির্মাণ এবং ১১টি স্টেশনে আধুনিক সিগন্যালিং ব্যবস্থা স্থাপন করা হবে।
