অপচয় কমানো ও নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সুনির্দিষ্ট প্রকল্প সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রকল্প পরিকল্পনা, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া উন্নত করার পদক্ষেপ নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে গতকাল একটি উচ্চপর্যায়ের সাড়ে চার ঘণ্টার কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত হয় এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীর মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন উপদেষ্টা, বিশেষ সহকারী, সিনিয়র সচিব, সচিব এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তারা। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ কর্মশালায় চালকের ভূমিকায় ছিলেন। আলোচনার সময় কর্মকর্তারা সরকারি প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন উন্নত করার জন্য একাধিক সুপারিশ উপস্থাপন করেন।
কর্মশালার পর সরকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি। তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, কর্মশালায় প্রকল্প সংক্রান্ত সকল সমস্যা এবং অস্পষ্টতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আমরা সকলেই চাই প্রকল্প ব্যবস্থাপনা আরো স্মুথ (নির্বিঘ্ন) এবং স্মার্ট (সুনিপুণ) হোক।'
সূত্র অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ৪৫৪টি প্রকল্প ছিল। এর মধ্যে ৬৬৮টি প্রকল্প পরিদর্শন করা হয়েছে, ৫৫টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে এবং ২১টির প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে।
কর্মশালায় প্রকল্প অনুমোদন এবং বাস্তবায়নের সেই পর্যায়গুলো বিশ্লেষণ করা হয়, যেখানে অনিয়মের সুযোগ থাকে এবং কেন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া প্রকল্পের বিরুদ্ধে আপত্তি জানাতে ব্যর্থ হন। অংশগ্রহণকারীরা বিদ্যমান আইন ও বিধিতে কোনো ফাঁক থাকলে সেগুলো দূর করার পরামর্শ দিয়েছেন।
একজন কর্মকর্তা জানান, প্রায়ই বড় প্রকল্পগুলোতে অনিয়ম এবং দুর্নীতি হয় যখন পছন্দের ব্যক্তিকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটি বন্ধে কর্মশালায় যোগ্য ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি পিডি পুল গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। পুলভুক্তরা ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট (আর্থিক ব্যবস্থাপনা), প্রোকিউরমেন্ট ম্যানেজমেন্ট (ক্রয় সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা) এবং প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্ট (প্রকল্প তদারকি) সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ পাবেন।
যেসব সমস্যা চিহ্নিত হয়েছে
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে, যেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নের সাধারণ সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। এতে সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—যথাযথ সম্ভবতা সমীক্ষা না করা, অংশীদারদের সঙ্গে খারাপ পরামর্শ, অযৌক্তিক ডিজাইন, ভুল লজিক্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, অযৌক্তিক ব্যয় অনুমান, পরিবেশগত বিষয় উপেক্ষা, মাস্টার প্ল্যান না মেনে চলা এবং পরামর্শক সংস্থার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা।
অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে—পূর্ণকালীন বা অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালক না থাকা, এক ব্যক্তিকে একাধিক প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়া, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন, ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস (প্রয়োজনীয় পরিষেবা যেমন: বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস) স্থানান্তরে সমন্বয়হীনতা, নিয়মিত নয় এমন এক্সটার্নাল অডিট এবং বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প অনুমোদনে বিলম্ব।
অতিরিক্ত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে—প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণে স্বীকৃত মডেল ব্যবহার না করা, আইএমইডি প্রতিনিধির মতামত যথাযথভাবে না নেওয়া, দুর্বল মনিটরিং, প্রকল্প মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব যথাসময়ে দাখিল না করা, ই-পিএমআইএসে তথ্য আপলোডে বিলম্ব, প্রকল্প সমাপ্তি প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব, অবকাঠামো সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রকল্পে বিশেষ জনবল নিয়োগে বিলম্ব।
সমাধানের পথ
আইএমইডি পরামর্শ দিয়েছে, প্রকল্প প্রণয়নের সময় পরিবেশগত বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া, মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী নির্মাণ ডিজাইন তৈরি করা, সংস্থার সক্ষমতা অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা এবং প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা। প্রকল্প দলিলে স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে, কীভাবে প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
কর্মশালায় আরও সুপারিশ করা হয়েছে—প্রকল্প সমাপ্তির প্রতিবেদন তিন মাসের মধ্যে আইএমইডিতে দাখিল করা, রাজস্ব বাজেটভিত্তিক প্রকল্পের অবকাঠামো ও যন্ত্রপাতি রক্ষণাবেক্ষণ করা এবং প্রকল্পের সুফল টেকসই রাখতে প্রয়োজনীয় জনবল অনুমোদন ও নিয়োগ নিশ্চিত করা।
এছাড়া, ভূমি অধিগ্রহণ এবং ইউটিলিটি সার্ভিস স্থানান্তরের জন্য পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে।