ধীরগতির বাস্তবায়ন: ৬৫ প্রকল্প চিহ্নিত করেছে ইআরডি; ২ লাখ কোটি টাকা ঋণ, ৯০ শতাংশ অব্যবহৃত

বৈদেশিক ঋণ ধীরগতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন ৬৫টি উন্নয়ন প্রকল্প চিহ্নিত করেছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এসব প্রকল্পে মোট ঋণের পরিমাণ আনুমানিক ২.০৪ লাখ কোটি টাকা। ইআরডি এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করতে চায়।
ইআরডি সূত্র জানায়, তিন থেকে ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান এসব প্রকল্পে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১৯,৭৪৪ কোটি টাকা—মোট ঋণের ৯.৬৯ শতাংশ—ব্যয় করা হয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বৈদেশিক ঋণের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করতে অর্থবছরের শেষদিকে ধীরগতির প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করা হয়। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুযায়ী এসব প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল সম্পূর্ণ ব্যয়ের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ১৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চলতি অর্থবছরের মূল এডিপিতে এগুলোর জন্য ২৪,২৯৭.২৮ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। তবে বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের সীমিত সক্ষমতার কারণে সংশোধিত এডিপিতে তা কমিয়ে ৯,৮০৭.৪৯ কোটি টাকা করা হয়।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মো. মামুন-আল-রশিদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, উন্নয়ন অংশীদাররা প্রকল্পের প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তহবিল ছাড় করে না। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক পরামর্শদাতা নিয়োগের আগেও বৈদেশিক ঋণ পাওয়া যায় না।
তিনি আরও বলেন, 'কিছু ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের নীতির কারণেও অর্থ ছাড়ে দেরি হয়। বিশেষ করে, ভূমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি প্রায়শই স্থবির হয়ে পড়ে। ইউটিলিটি স্থানান্তরেও দেরি হয়, যা প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত করে এবং তহবিল ছাড়ে বিঘ্ন ঘটায়।'
তিনি জানান, দ্বিপাক্ষিক ঋণের ক্ষেত্রেও উন্নয়ন অংশীদারদের নীতিগত জটিলতার কারণে অর্থ ছাড় ব্যাহত হয়। উদাহরণস্বরূপ, চীনের কিছু প্রকল্পে ব্যয় প্রাক্কলন বেশি থাকায় জটিলতা সৃষ্টি হয়, আর ভারতীয় ঋণের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে তহবিল ছাড়ে বিলম্ব হয়।
বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, অবকাঠামো প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শদাতা ও নির্মাণ ঠিকাদাররা অংশ নিতে অনাগ্রহী। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে দরপত্রে অংশগ্রহণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে বারবার দরপত্র আহ্বান করতে হয়, যা প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘায়িত করে।
৩৩ প্রকল্পে ০-১ শতাংশ তহবিল ছাড়া
ইআরডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চিহ্নিত ৬৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টিতে মাত্র ০-১ শতাংশ বৈদেশিক ঋণ ছাড় করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৩টি প্রকল্পে ১ শতাংশেরও কম বা কোনো তহবিল ছাড় করা হয়নি।
এছাড়া, ১২টি প্রকল্পে ২-১০ শতাংশ, আটটি প্রকল্পে ১১-২০ শতাংশ এবং বাকি ১২টি প্রকল্পে ২১ শতাংশ বা তার বেশি ঋণ ব্যয় হয়েছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, 'যদি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, নকশা, জমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি স্থানান্তরসহ অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে প্রকল্প অনুমোদন ও ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়, তাহলে তহবিল ছাড়ের জটিলতা কমবে। পাশাপাশি, পরামর্শদাতা নিয়োগের জন্য অগ্রিম ক্রয় প্রক্রিয়া আগেভাগেই শুরু করতে হবে।'
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকল্প অনুমোদন বা ঋণ চুক্তির আগেই অগ্রিম ক্রয় প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এনডিবি) সঙ্গে কয়েকটি প্রকল্পে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তাদের মতে, ঋণ চুক্তির আগে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন হলে উন্নয়ন অংশীদাররা কমিটমেন্ট ফি নেয় না। তবে অনিষ্পন্ন ঋণের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিটমেন্ট ফি প্রযোজ্য হয়।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনেক উন্নয়ন প্রকল্প যথাযথ সম্ভাব্যতা সমীক্ষা বা স্টেকহোল্ডারদের পরামর্শ ছাড়াই শুরু করা হয়। ফলে প্রকল্পের ইনপুট ও আউটপুট যথাযথভাবে নথিভুক্ত হয় না, যা বাস্তবায়নের সময় জটিলতা তৈরি করে এবং তহবিল ছাড়ে দেরি ঘটায়।
আটটি সড়ক পরিবহন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি
বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের ধীরগতির কারণে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের আটটি প্রকল্প চিহ্নিত হয়েছে। ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, এসব প্রকল্পের জন্য ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বৈদেশিক ঋণ বরাদ্দ থাকলেও, এর মধ্যে ৯৫,৬৬০ কোটি টাকা এখনও পাইপলাইনে আটকে আছে।
জাপানের অর্থায়নে পরিচালিত দুটি মেট্রোরেল প্রকল্পও ধীরগতির তালিকায় রয়েছে। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিমানবন্দর-কমলাপুর 'লাইন-১' প্রকল্পে জাপানের বরাদ্দ করা ৩৯,৪৫০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ জাইকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে।
ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (লাইন-১)-এর প্রকল্প পরিচালক আবুল কাশেম ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, প্রকল্পের ১১টি নির্মাণ প্যাকেজের টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও শেষ হয়নি। ফলে, জাপানের ঋণ থেকেও অর্থ ছাড় শুরু করা যায়নি। তিনি আশা করছেন, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই সব ঠিকাদার নিয়োগ চূড়ান্ত হবে।
তিনি আরও জানান, জমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, বিভিন্ন সংস্থার ইউটিলিটি স্থানান্তর এবং জাইকার বারবার অনুমোদন পেতে দেরি হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়ন পিছিয়ে পড়ছে, যা তহবিল বিতরণেও প্রভাব ফেলছে।
এ কারণে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) এ প্রকল্পের জন্য ১,২৬৮ কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে এই অর্থ সময়মতো ব্যয় করা সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
অন্যদিকে, এমআরটি লাইন-৫ (হেমায়েতপুর-মিরপুর ১০-গুলশান-ভাটারা) প্রকল্পের জন্য জাপান ২৯,১১৭ কোটি টাকা ঋণ দিলেও, গত পাঁচ বছরে এর মাত্র ৩ শতাংশ বিতরণ করা হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীনে যেসব প্রকল্পে ১ শতাংশেরও কম বৈদেশিক ঋণ ব্যবহার হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম কোরিয়ার অর্থায়নে বিআরটিসির জন্য সিএনজি সিঙ্গেল ডেকার এসি বাস সংগ্রহ প্রকল্প। ২০২৩ সালের জুনে শুরু হওয়া প্রকল্পটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা।
বিআরটিসির উপ-মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা) মো. আবু বকর সিদ্দিক জানান, প্রকল্পের জন্য ইতোমধ্যে একজন পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং শিগগিরই বাস ক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হবে।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পেও পরামর্শক নিয়োগে দেরির কারণে তিন বছর পার হলেও এখনো কোনো বৈদেশিক ঋণ বিতরণ করা যায়নি। একই কারণে সিলেট-চরখাই-শেওলা মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের তহবিল ছাড়ও আটকে আছে।
এছাড়া, কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪-লেন জাতীয় মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পসহ আরও কয়েকটি প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি খুবই ধীর।
ধীরগতির তালিকায় আটটি রেল প্রকল্প
ইআরডি আটটি রেল প্রকল্পকেও ধীরগতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যার মধ্যে পাঁচটি ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এছাড়া, একটি করে প্রকল্প এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), কোরিয়া, এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (ইআইবি) অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত তিনটি রেল প্রকল্পে মাত্র ১ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। প্রকল্পগুলো হলো—বগুড়া থেকে শহীদ এম. মনসুর আলী স্টেশন পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ, খুলনা-দর্শনা ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ এবং পার্বতীপুর-কাউনিয়া মিটার গেজ লাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তর।
এছাড়া, ভারতীয় ঋণের কুলাউড়া-শাহবাজপুর পুনর্বাসন, ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর ডুয়েল গেজ ট্র্যাক ডাবলিং প্রকল্পও ধীরগতির তালিকায় রয়েছে।
বিদ্যুৎ ও নৌপরিবহন খাতেও বিলম্ব
ইআরডি ছয়টি বিদ্যুৎ প্রকল্পকেও ধীরগতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে, যার মধ্যে দুটি জার্মানির কেএফডব্লিউ-এর অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এছাড়া, স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৫টি প্রকল্পও বৈদেশিক ঋণ ব্যবহারের ধীরগতির তালিকায় রয়েছে। এসব প্রকল্পের সম্মিলিত ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ২৫,৬২২ কোটি টাকা থাকলেও, এর মধ্যে ২৫,৫০৫.৫৭ কোটি টাকা এখনও অব্যবহৃত রয়েছে।
অন্যদিকে, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১৭,৬১১ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হলেও, ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ১.১ শতাংশ ঋণ বিতরণ হয়েছে। ফলে ১৭,৪১৮ কোটি টাকা এখনও পাইপলাইনে রয়ে গেছে।