গত নির্বাচনের আলোচিত ‘কিংস পার্টি’ এখন কোথায়?
আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত গত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে ৪০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল। সে সময় স্বল্পপরিচিত বেশ কয়েকটি দল হঠাৎ করেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিবন্ধনও পায়। এসব দলে বিএনপির একাধিক দলছুট নেতা বড় পদে যোগ দিয়েছিলেন।
কিছু সময়ের জন্য তথাকথিত এই 'কিংস পার্টি' বেশ সাড়া ফেললেও এখন তাদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক দলের জন্য অফিস খোলা রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একসময় সম্ভাবনাময় বলে বিবেচিত নতুন এই দলগুলো এখন রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে—কেউ নিজেদের নতুনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে, কেউ পুনর্গঠনের পথ খুঁজছে, আবার কেউ নিঃশব্দে আলোচনার বাইরে সরে যাচ্ছে।
এসব দলের মধ্যে রয়েছে তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। নির্বাচনকে সুষ্ঠু দেখানোর উদ্দেশ্যে তৎকালীন সরকারের নির্দেশে এসব 'কিংস পার্টি'র উত্থান হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে সক্রিয় থাকলেও পরে দলগুলো প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
ভেতরের খবর অনুযায়ী, এই দলগুলো আসলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে জনসমালোচনার চাপ কমানো এবং বহুদলীয় প্রতিযোগিতার মুখোশ তৈরি করার সুবিধাজনক হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মতে, পরিচিত মুখদের আর্থিক সুবিধা ও রাজনৈতিক গুরুত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলে টেনে এনে বিএনপির সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল করার একটি হিসাবকষা কৌশলের অংশ ছিল এসব দলের আকস্মিক উত্থান।
তবে ২০২৪ সালের নির্বাচন শেষে অধিকাংশ দলই ক্রমশ রাজনৈতিক নিস্তব্ধতায় চলে যায়। এখন, আরেকটি নির্বাচন সামনে রেখে কেউ নিজেদের নতুন করে দাঁড় করাতে চাইছে, কেউ বিএনপিতে ফেরার পথ খুঁজছে, আবার কেউ পুরোপুরি রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে সরে যেতে চাইছে।
কার্যক্রম বন্ধ বিএনএমের, বিএনপিতে ফিরতে চান নেতারা
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা পায় বিএনএম। দলটির সাবেক মহাসচিব ড. মোহাম্মদ শাহজাহানসহ দুই–তিনজন সেই টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেন।
নির্বাচনের পর ২০২৪ সালের ১৩ জুন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে মহাসচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন শাহজাহান। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় তিনি আওয়ামী লীগের হয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলন দমাতে অংশ নেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে আদালতে দুটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনএমের সাবেক মহাসচিব ড. শাহজাহান বলেন, "অনেককে হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এসব মামলা দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন-কালীন টাকা পাওয়া কথাও জঘন্য মিথ্যাচার।"
তিনি আরও বলেন, "আমি এখন রাজনীতিতে নেই। শেখ হাসিনার নির্বাচনের কারচুপির বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে চাপে পড়েছিলাম, তাই পদত্যাগ করি।"
বিএনএমের প্রতিষ্ঠাকালীন মুখপাত্র ও সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন বলেন, বিএনএম যে লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল, সেখান থেকে দলটি সরে গেছে।
তিনি জানান, দলটি যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়, তখনই তারা দল ছাড়েন।
সাবেক মহাসচিব শাহজাহান সম্পর্কে তিনি বলেন, "আওয়ামী লীগের সঙ্গে নির্বাচন করে প্রায় ১০ কোটি টাকা নিয়েছেন শাহজাহান। এখন সেই টাকা দিয়ে বিএনপির কাউকে না কাউকে প্রভাবিত করে দলে ফেরার চেষ্টা করছেন।"
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, গত নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের বিএনএমে আনার দায়িত্বে ছিলেন দলটির কো-চেয়ারম্যান ড. কামরুল আহসান এবং বিশেষ বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন কর্মকর্তা।
সূত্র আরও জানায়, ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনএমের অনেক নেতা আবার সরকার ও বিএনপির নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করছেন।
কামরুল আহসান এখন নিয়মিতই সরকারের দুয়েকজন উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাতায়াত করছেন বলে জানা গেছে। তিনি বিভিন্ন মহলে ওই উপদেষ্টাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথাও প্রচার করছেন। এছাড়া নিজের ফেসবুকে কখনো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণ, আবার কখনো শহিদ আবু সাঈদের ভাইয়ের সঙ্গে তোলা ছবি পোস্ট করছেন।
স্থবির তৃণমূল বিএনপির কার্যক্রম
গত নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত দলের একটি ছিল তৃণমূল বিএনপি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হুদা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি থেকে আসা একটি অংশ দলটিতে যোগ দেয়। দলটি শুরুতে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ১৩৫ আসনে প্রার্থী দেয়। কোনো আসনেই জয় পায়নি।
বর্তমানে দলটির কার্যক্রম প্রায় অচল। দলটির চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না দলটি। তৃণমূল বিএনপি দলীয় নাম পরিবর্তনের বিষয়ে মৌখিকভাবে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে।
দলটির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নির্বাচন নিয়ে আমরা কিছু ভাবছি না। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়ার ক্ষমতা এই সরকারের নেই। এখনো চাঁদাবাজি, মব সন্ত্রাস, জুলুম-অত্যাচার বন্ধ হয়নি। দলীয় নাম পরিবর্তনের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছি। তারা যদি অনুমতি না দেয়, তাহলে নতুনভাবে চিন্তা করবো।"
বিএসপি: নির্বাচনে ভরাডুবি থেকে নতুন 'বৃহত্তর সুন্নি জোট'
২০২৩ সালের ১০ আগস্ট নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একতারা প্রতীক নিয়ে ৭৯ আসনে প্রার্থী দেয়। ভরাডুবি হয় দলটির। চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসন থেকে দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমেদ মাইজভাণ্ডারী নির্বাচন করে মাত্র ৩,১৫১ ভোট পান।
এখন অতীত ভুলে নতুন জোট গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। তিনটি ইসলামি দলকে নিয়ে 'বৃহত্তর সুন্নি জোট' গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জোটের অন্য দল দুটি হলো বাংলাদেশী ইসলামী ফ্রন্ট এবং ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ। সারাদেশের ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা। ইতোমধ্যে ১৩ দফা দাবিতে বিভাগীয় শহরগুলোতে জনসভাও শুরু হয়েছে।
দলটির যুগ্ম মহাসচিব ইব্রাহিম মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সুন্নিপন্থী দলগুলো নিয়ে আমরা নতুন জোট করেছি। এই জোট থেকেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবো। ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।"
