বোয়িং বনাম এয়ারবাস: বাংলাদেশের আকাশে তীব্র প্রতিযোগিতার আভাস
বাংলাদেশের এভিয়েশন (বিমান পরিবহন) বাজারে ঢুকতে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিচ্ছে এয়ারবাস। আর এবার সময়ের হিসাবটাও খুব ভালোভাবেই কষেছে ইউরোপের বৃহৎ এই বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
ইউরোপের চার দেশের রাষ্ট্রদূতদের যৌথ আহ্বানে বিমানের বহরে এয়ারবাস যুক্ত করার সুপারিশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছেছেন এয়ারবাসের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল) ওয়াউটার ভ্যান ওয়ার্শ।
এয়ারবাস সূত্র জানায়, তিনি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা—বিশেষ করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে—এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন।
এর আগে, গত ১০ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন ওয়াউটার ভ্যান ওয়ার্শ। সে বৈঠকে বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারিত্বের আগ্রহ প্রকাশ করে এয়ারবাস।
গত ৪ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা বিমানের বহরে এয়ারবাস যুক্ত করার পক্ষে মত দেন। তাদের যুক্তি ছিল—যুক্তরাষ্ট্রের বোয়িংনির্ভর বহরে বৈচিত্র্য আনলে বিমানের অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়বে, পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে।
বর্তমানে বিমানের বহরে মোট ১৯টি উড়োজাহাজ রয়েছে—এরমধ্যে ১৪টিই বোয়িংয়ের।
তবে এর আগে, চলতি বছরের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে আলোচনার সময় সরকার জানায়, বোয়িংয়ের ২৫টি উড়োজাহাজ কিনবে বাংলাদেশ—যার প্রথমটি ২০২৯ সালে আসার কথা। এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি এএফপিকে বলেন, এই প্রতিশ্রুতি মূলত ওয়াশিংটনের সঙ্গে বৃহত্তর বাণিজ্য ব্যবস্থার অংশ।
এই পরিস্থিতিতে এয়ারবাসের পক্ষ থেকে নতুন করে যোগাযোগ এবং ইউরোপীয় দেশগুলোর সমন্বিত কূটনৈতিক বার্তা দেশের এভিয়েশন খাতে নতুন প্রশ্ন তুলেছে: ইইউ যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, সেখানে এয়ারবাসের প্রস্তাব কি বাংলাদেশ ফিরিয়ে দিতে পারবে?
ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার জানান, ২০২৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২২.২ বিলিয়ন ইউরো। এরমধ্যে ইইউর বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৭.৫ বিলিয়ন ইউরো—যা তিনি ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য 'সমান সুযোগ' বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন।
এখন ঝুঁকির মুখে শুধু একটি উড়োজাহাজের ক্রয়াদেশ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের জন্য এক বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভূরাজনৈতিক চাপ, অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে চলা লোকসান, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও বোয়িং-নির্ভর একমুখী বহর কৌশলে পিছিয়ে থাকা জাতীয় বিমান সংস্থাকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা।
উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক প্রভাব? সতর্ক থাকার আহ্বান বিশেষজ্ঞদের
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উড়োজাহাজ কেনাকে কূটনৈতিক লেনদেন হিসেবে দেখা হলে তা হবে ঝুঁকিপূর্ণ।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার এ টি এম নাজরুল ইসলাম বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চলাকালে আমি সতর্ক করেছিলাম—যদি উড়োজাহাজ ক্রয় কোনো চুক্তির সঙ্গে যুক্ত করা হয়, তবে এয়ারবাসও একই ধরনের চাপ দেবে।
"কিন্তু এ সিদ্ধান্ত কোনো রাজনৈতিক চাপে নেওয়া উচিত হবে না। এটি পুরোপুরি ব্যবসায়িক দিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। এটি বাণিজ্যিক যুক্তি ও যথাযথ হিসাব–নিকাশের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত," যোগ করেন তিনি।
বিমান বোর্ডের সাবেক সদস্য ও এভিয়েশন বিশ্লেষক কাজী ওয়াহিদুল আলমও একই কথা বললেন, নতুন উড়োজাহাজ কেনা মানেই বিমানের উন্নতি নয়—এর আগে সংস্থার অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
তিনি বলেন, "ইউরোপ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার, ভবিষ্যতে ইউরোপে নতুন আরও গন্তব্য তৈরির পরিকল্পনা আছে। তাই কূটনৈতিক সম্পর্ক অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু উড়োজাহাজ আনা যথেষ্ট নয়—বিমান যদি সেগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করতে না পারে, তবে উল্টো ক্ষতিই হবে।"
এয়ারবাসের প্রস্তাব
১০টি এ৩৫০ ওয়াইড–বডি এবং ৪টি এ৩২০নিও ন্যারো–বডি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাব দিয়েছে এয়ারবাস। অন্যদিকে, বোয়িংয়ের প্রস্তাবে রয়েছে ১০টি বি৭৮৭ এবং ৪টি বি৭৩৭ ম্যাক্স।
বিমান এয়ারবাসের প্রস্তাব পর্যালোচনা করলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি সংস্থা এ মূল্যায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সরাসরি কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সংস্থার মুখপাত্র এবং বেসামরিক বিমান চলাচল খাতের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
এয়ারবাসের রিজিওনাল সেলস ডিরেক্টর রাফায়েল গোমেজ বলেন, প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিতভাবে বিমান এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তিনি জানান, "প্রতিটি সফরেই আমরা আমাদের প্রস্তাব তুলে ধরছি এবং ব্যাখ্যা করছি বাংলাদেশ কীভাবে আমাদের প্রযুক্তি ও অংশীদারিত্ব মডেল থেকে উপকৃত হতে পারে।"
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা সরকার পরিবর্তন হলে এয়ারবাসের সম্ভাব্য চুক্তিতে প্রভাব পড়বে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে রাফায়েল বলেন, "এয়ারবাস একটি অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আমরা অপারেটর এবং যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট দেশের ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই কাজ করে থাকি।"
এভিয়েশন নিউজ পোর্টাল সিম্পল ফ্লাইং–এর ২০২৩ সালের শেষ দিকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এয়ারবাসের ফ্ল্যাগশিপ ওয়াড–বডি উড়োজাহাজ এ৩৫০–৯০০–এর তালিকাভুক্ত মূল্য ৩১৭.৪ মিলিয়ন ডলার। এর বড় সংস্করণ এ৩৫০–১০০০–এর তালিকামূল্য ৩৬৬.৫ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে, এ৩২০সিইও–এর তালিকামূল্য ১০১ মিলিয়ন ডলার এবং এ৩২০নিও বিক্রি হয় ১১০.৬ মিলিয়ন ডলারে।
বহরে বৈচিত্র্যতা নিয়ে বিতর্ক: কৌশলগত, নাকি ব্যয়বহুল?
বিশ্বের প্রায় সব শীর্ষ এয়ারলাইনই রুট দক্ষতা, খরচ কাঠামো এবং অপারেশনাল নমনীয়তা বাড়াতে বহরে বৈচিত্র্য এনে থাকে। বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও বিষয়টি স্বীকার করেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এ টি এম নাজরুল ইসলাম বলেন, "দুনিয়ার সব বড় এয়ারলাইনই ব্যালান্সড ফ্লিট বজায় রাখে। প্রতিটি আলাদা উড়োজাহাজের নিজস্ব সুবিধা রয়েছে—কিছু ক্ষেত্রে বোয়িংয়ের বিশেষ দক্ষতা আছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে এয়ারবাস এগিয়ে।"
তবে উদ্বেগের কথা হলো, বিমান কি এই অতিরিক্ত জটিলতা সামলাতে পারবে? এয়ারবাস যুক্ত হলে নতুন প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা এবং যন্ত্রাংশের আলাদা ইনভেন্টরি তৈরির প্রয়োজন হবে।
এসব প্রশ্নের জবাবে ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ায় এয়ারবাসের মার্কেটিং প্রধান মনাল শেশ বলেন, বহরে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত করার ব্যয় পুরো জীবনচক্রের মোট খরচের তুলনায় খুবই কম।
তিনি বলেন, "বাংলাদেশে নতুন উড়োজাহাজ সফলভাবে অন্তর্ভুক্ত করার উদাহরণ ইতোমধ্যেই আছে।" এসময় তিনি এ৩৩০ পরিচালনাকারী একটি স্থানীয় এয়ারলাইনের কথা উল্লেখ করে বলেন, "দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি দক্ষতা, নির্ভরযোগ্যতা ও পারফরম্যান্স—এই সবকিছুই নতুন অন্তর্ভুক্তির প্রাথমিক ব্যয়কে পুষিয়ে দেয়।"
রুট পরিকল্পনা ও আর্থিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন
বিমানের সমস্যা শুধু বহর বিন্যাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সংস্থাটি বর্তমানে ২২টি আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তবে আর্থিক ক্ষতির কারণে সম্প্রতি ঢাকা–নারিতা রুট স্থগিত হওয়ার পর তাদের সামগ্রিক রুট কৌশল নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
তৃতীয়বারের মতো এই রুট বন্ধ করেছে বিমান। সংস্থাটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকা–নারিতা–ঢাকা রুট চালুর আগে বিমান বাণিজ্যিক সম্ভাব্যতা বা লাভের সম্ভাবনা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনি।
বিমানের আর্থিক দুর্বলতাও বেশ প্রকট। গত অর্থবছরে ৯৩৭ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা দেখালেও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) কাছে ৬,০৬৮.৫৪ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে সংস্থাটির। বেবিচক সূত্র জানায়, এর মধ্যে ৪,৭৯৪.১৩ কোটি টাকা শুধুই সারচার্জ; মূল টাকা মাত্র ৭৪৫.৫২ কোটি।
বিমানের সদ্য সাবেক মুখপাত্র এ বি এম রওশন কবীর টিবিএসকে বলেন, "বিমানবন্দরের কাছে আমাদের যেসব বকেয়া রয়েছে, তার প্রায় ৭৯ শতাংশই সারচার্জ। পুরোনো বিলের ওপর আরোপিত এই অতিরিক্ত সারচার্জ আমরা পরিশোধ করিনি, কারণ আমরা এগুলোর সঙ্গে একমত নই।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান বিলগুলো নিয়মিত পরিশোধ করা হচ্ছে। পুরোনো বিল নিয়ে আলোচনা চলছে, এবং উভয়পক্ষ সমঝোতায় পৌঁছালে এগুলো কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে।"
আলোচনা এগিয়ে নেবে অন্তর্বর্তী সরকার?
দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়ের প্রতিশ্রুতিতে সতর্ক অন্তর্বর্তী সরকার বিমান কেনার আলোচনা কতটা এগিয়ে নেবে—তা এখনো অনিশ্চিত। কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেতে চাননি। এবং নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগের মূল্যায়ন প্রক্রিয়া এগোবে কিনা, সেটিও এই মুহূর্তে পরিষ্কার বলা যাচ্ছে না।
তাছাড়া ১০টি এয়ারবাস উড়োজাহাজ কেনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছিল আগের সরকারের আমলেই। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকের পর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ প্রকাশ্যে বাংলাদেশকে এয়ারবাস থেকে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার প্রতিশ্রুতির জন্য ধন্যবাদ জানান।
এদিকে, কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ আরও বাড়াচ্ছে এয়ারবাস। অন্যদিকে, বহরে বিমানের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ও অপারেশনাল চাপের মুখে রয়েছে বিমান। দ্রুত বাড়তে থাকা বৈশ্বিক এভিয়েশন বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশি এয়ারলাইনগুলোর শেয়ার মাত্র ২৫ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহর বৈচিত্র্য বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত প্রয়োজন হবে নাকি ভূরাজনৈতিক আপস—তা নির্ভর করবে সামনে সরকার কীভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থ, এভিয়েশন চাহিদা ও ক্রয় প্রক্রিয়ার ভারসাম্য রক্ষা করে তার ওপর।
