বিমানের বহরে এয়ারবাস যুক্ত করতে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের তদবির
ঢাকায় নিযুক্ত ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে তাদের বহরে এয়ারবাস যুক্ত করতে যৌথভাবে আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, বহরের এই বৈচিত্র্য জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থাটির ফ্লেক্সিবিলিটি, প্রতিকূলতা মোকাবিলার সক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
গতকাল (৪ নভেম্বর) ঢাকায় ফ্রাঙ্কো-জার্মান দূতাবাসে এয়ারবাসের উদ্যোগে আয়োজিত 'ইউরোপিয়ান ডায়ালগ অন বাংলাদেশ এভিয়েশন গ্রোথ' শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই আহ্বান জানানো হয়।
ফ্রান্সের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জাঁ-মার্ক সেরে-শার্ল বলেন, 'সংযুক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদে বাংলাদেশের একটি আঞ্চলিক অ্যাভিয়েশন হাবে পরিণত হওয়ার সব উপাদানই রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, এই রূপান্তরকে সমর্থন দিতে এয়ারবাস বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কাছে একটি পূর্ণাঙ্গ ও প্রতিযোগিতামূলক সমাধান উপস্থাপন করেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি, এয়ারবাসের এ প্রস্তাবে এই বহুজাতিক কোম্পানির অংশীদার চার ইউরোপীয় দেশেরই জোরালো সমর্থন রয়েছে। আমাদের নিজ নিজ রপ্তানি ঋণ সংস্থাগুলোও ইতিমধ্যে এই চুক্তিকে সমর্থন দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।'
সেরে-শার্ল বলেন, বাংলাদেশ যখন এ অঞ্চলে এভিয়েশন খাতের গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে, ইউরোপ তখন এয়ারবাসের মাধ্যমে এই যাত্রায় সমর্থন জোগাতে প্রস্তুত।
বিমানের আসন্ন বড় আকারের উড়োজাহাজ ক্রয়কে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বোয়িং ও ইউরোপের এয়ারবাসের মধ্যে চলমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার সরাসরি প্রতিক্রিয়া এই কূটনৈতিক তৎপরতা। বিমানের কারিগরি-আর্থিক কমিটি বর্তমানে দুটি প্রস্তাব পর্যালোচনা করছে: এয়ারবাসের ১০টি এ৩৫০ ওয়াইড-বডি ও চারটি এ৩২০নিও ন্যারো-বডি উড়োজাহাজের প্রস্তাব এবং বোয়িংয়ের ১০টি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার ও চারটি ৭৩৭ ম্যাক্স জেটের প্রস্তাব।
রপ্তানির ওপর পারস্পরিক শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বোয়িং থেকে ২৫টি উড়োজাহাজ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে অনুষ্ঠানে ঢাকায় নিযুক্ত জার্মান রাষ্ট্রদূত রুডিগার লোটজ বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি ও উদীয়মান মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রেক্ষাপটে বিমানের আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব উড়োজাহাজ প্রয়োজন—এবং এয়ারবাস সেগুলো সরবরাহ করার জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আঞ্চলিক অ্যাভিয়েশন হাব হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থনের ব্যাপারে যুক্তরাজ্য সরকারের অব্যাহত প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
বাণিজ্যিক সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতার ওপর গুরুত্ব ইইউ দূতের
বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূত মাইকেল মিলার দুই অংশীদারের মধ্যে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক তুলে ধরে বাংলাদেশে পরিচালিত ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর জন্য স্বচ্ছতা ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, 'ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। ২০২৪ সালে ইইউ ও বাংলাদেশের মধ্যে পণ্য বাণিজ্য ২২.২ বিলিয়ন ইউরোতে পৌঁছেছে, যেখানে ইইউয়ের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১৭.৫ বিলিয়ন ইউরো—এই ঘাটতি অন্য যেকোনো অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘাটতির চেয়ে অনেক বেশি।'
ভবিষ্যতের কথা উল্লেখ করে মিলার বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) কাতার থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের এই প্রক্রিয়া মসৃণ করতে ইইউ তার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছে।
তিনি আরও বলেন, আসন্ন পার্টনারশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন অ্যাগ্রিমেন্ট এবং জিএসপি কাঠামো ইইউ-বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ তৈরি করেছে।
মিলার বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের প্রতি এই অংশীদারত্বকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাই। সংক্ষেপে, আমরা অনুরোধ করছি যে আমাদের অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোকে যেন বাণিজ্যিক যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা করতে দেওয়া হয়। আমরা একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রত্যাশা করি—অর্থাৎ ইইউয়ের প্রতিষ্ঠানগুলো যেন অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের চেয়ে কম সুবিধাজনক আচরণ না পায়।'
বাংলাদেশে এভিয়েশন খাতকে ইইউয়ের একটি কৌশলগত অগ্রাধিকার হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, 'ইউরোপীয় এভিয়েশন খাত আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রসঙ্গে আমি বিমানের আসন্ন বহর নবায়ন পরিকল্পনায় এয়ারবাসকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য স্পষ্টভাবে আহ্বান জানাতে চাই, যা বাংলাদেশের স্বচ্ছতা ও বৈষম্যহীনতার দীর্ঘদিনের আশ্বাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ।'
এয়ারবাসের ভারত ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের মার্কেটিং প্রধান মোনাল শেশ ও কমার্শিয়াল সেলস ডিরেক্টর রাফায়েল গোমেজ নয়াও বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বিষয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরে বিমান ও সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
এয়ারবাসের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা
এয়ারবাসের নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট উটার ভ্যান ওয়ার্শ গত ১০ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার হোটেলে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের সঙ্গে এই এভিয়েশন জায়ান্টের দীর্ঘমেয়াদি অংশীদারত্ব গড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রধান উপদেষ্টাকে ওয়ার্শ বলেন, 'আমরা বাংলাদেশকে অন্যতম অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছি।' তিনি আরও বলেন, তার কোম্পানি বিমানের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়তে এবং একে লাভজনক করে তুলতে আগ্রহী।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এক বৈঠকের পর এয়ারবাস থেকে ১০টি বিমান কেনার প্রতিশ্রুতির জন্য বাংলাদেশকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
