ভূমিকম্প ঝুঁকি ও প্রস্তুতি: যা বলছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ড. গোলাম মঈনুদ্দিন
গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে দেশজুড়ে অন্তত ১০ জনের প্রাণহানি এবং ৪৬০ জন আহত হয়েছেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পরদিন শনিবার দুপুর ও সন্ধ্যায় রাজধানীতে আরও তিন দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। নতুন এসব কম্পনে হতাহত বা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও নগরবাসীর মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতি কমাতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় খোলা স্থানের ব্যবস্থা রাখা, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা কঠোরভাবে মেনে চলা এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
এসব বিষয় নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. গোলাম মঈনুদ্দিন।
টিবিএস: নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে দেশের ভূমিকম্পের সার্বিক পরিস্থিতি ও ঝুঁকিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
আমরা সম্ভবত ধীরে ধীরে একটি বড় শঙ্কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি যদি একটু পেছনের দিকে তাকাই—২০১৪ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত; আমরা বেশ কিছু ভূকম্পনের অভিজ্ঞতা পেয়েছি। এর মধ্যে গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) যে ভূমিকম্পটি হলো, আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী এর ব্যাপকতা ও মাত্রা ছিল সবচেয়ে বেশি।
ভূমিকম্প আসলে একটি অনিশ্চিত বিষয়। এটি কখন, কোথায়, কীভাবে আঘাত হানবে, তা আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণ বা অনুধাবন হলো—ঢাকা শহর অফিস-আদালত ও আবাসনের দিক থেকে অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে এই শহরে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা খুবই প্রকট।
আমরা বিভিন্ন সময় নানা পরিসংখ্যান শুনছি—বড় ভূমিকম্প হলে কারও মতে ১ লাখ, কারও মতে ৫ বা ৮ লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। সংখ্যাটা যাই হোক, সম্ভাব্য ক্ষতির পরিমাণ যে আমাদের কল্পনার বাইরে হবে, তা নিশ্চিত।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, আমরা কতটা প্রস্তুত? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের প্রস্তুতি এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পের ঘটনাগুলো সার্বিকভাবে বিশ্লেষণ করলে মনে হয়, আমাদের সতর্ক হওয়া জরুরি এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
টিবিএস: দেশে বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বা পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে, খনিজ সম্পদের উৎসও রয়েছে। ভূমিকম্পের ফলে এসব স্থাপনা বা জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা আছে কি?
অবশ্যই, ভূমিকম্পের প্রভাব এগুলোর ওপর পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই খবরে দেখেছেন বা সংবাদপত্রে পড়েছেন যে, ভূমিকম্পের পর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অথবা নিরাপত্তার স্বার্থে সেটিকে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছিল।
এগুলো হলো দেশের 'কি-পয়েন্ট ইনস্টলেশন' (কেপিআই) বা লাইফলাইন। যদি এগুলোতে কোনো বড় বিপর্যয় ঘটে কিংবা দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে, তবে পুরো দেশ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হবে।
আন্তর্জাতিক উদাহরণের দিকে তাকালে দেখা যায়, ২০১১ সালে জাপানে যে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও সুনামি হয়েছিল, তাতে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটেছিল ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে। সেই তেজস্ক্রিয় দূষণ কানাডার পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
অবশ্য আমরা এখনো সেই পর্যায়ে নেই, কারণ আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি চালু হয়নি। কিন্তু আমাদের ডিজেল, গ্যাস বা অন্যান্য জ্বালানিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমাদের অর্থনীতি ও জনজীবন স্থবির হয়ে পড়বে। বাসস্থানের পাশাপাশি এসব স্পর্শকাতর স্থাপনাও ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এক বা একাধিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিকল হয়ে গেলে দেশের বড় একটি অংশ অচল হয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে।
টিবিএস: সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটি মাঝারি মাত্রার ছিল। কিন্তু ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জের মতো জনবহুল শহরের বিদ্যমান অবকাঠামোগুলো ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পের ধাক্কা সামলাতে কতটা প্রস্তুত?
গত ১০–১৫ বছরে আমাদের দেশে প্রচুর বহুতল ভবন ও বড় স্থাপনা নির্মিত হয়েছে। তবে এগুলো ভূমিকম্প সহনশীল করে তৈরি করা হয়েছে কি না—সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
যদিও উন্নয়ন সংস্থা এবং রাজউকের সুনির্দিষ্ট ইমারত নির্মাণ বিধিমালা (বিল্ডিং কোড) রয়েছে, কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন আছে। আমরা জানি, নিয়মের ব্যত্যয় ঘটার অনেক নজির রয়েছে। তাই সব সুউচ্চ ভবন যে নিয়ম মেনে ভূমিকম্প সহনশীল হিসেবে তৈরি হয়েছে, তা মনে করার কারণ নেই।
নির্ভরযোগ্য তথ্য বা ডাটাবেস না থাকায় ঝুঁকির পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে যেহেতু অনিয়মের আশঙ্কা প্রবল, তাই অপরিকল্পিত ও নিয়মবহির্ভূত ভবনের সংখ্যা যত বেশি হবে, ঝুঁকিও তত বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক।
টিবিএস: ভূমিকম্পের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ১৫ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অনেকে বলছেন, ভূমিকম্প তো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেখানেই থাকি সচেতন থাকা উচিত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এখনো খোলা। সব মিলিয়ে বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
২০২১ সালে রাজউকের একটি কারিগরি দল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এসে বিভিন্ন স্থাপনার ঝুঁকি মূল্যায়ন করেছিল। সে সময় তারা কিছু স্থাপনাকে সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে সেগুলো পরিত্যাগ করার অথবা 'রেট্রোফিটিং' বা সংস্কার করার সুপারিশ করেছিল।
অন্যদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো আবাসিক ও একাডেমিক ভবনগুলো পাকিস্তান আমলের তৈরি, অর্থাৎ এগুলোর বয়স ৬০–৬৫ বছর পেরিয়ে গেছে। এসব ভবনের ঝুঁকি মূল্যায়ন ও রেট্রোফিটিং আরও অনেক আগেই করা উচিত ছিল, যা এখন ভূমিকম্পের পর শুরু হয়েছে।
আমাদের ক্যাম্পাসেও অনেক পুরনো ভবন আছে—কিছু শুধু ইটের গাঁথুনি দিয়ে তৈরি (লোড বেয়ারিং), কিছু বিম-কলাম কাঠামোর। গঠনভেদে এগুলোর ঝুঁকিও ভিন্ন। কোন ভবনটি ব্যবহারযোগ্য আর কোনটির জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন; তা এখনো স্পষ্টভাবে চিহ্নিত নয়।
আমার মতে, আমাদেরও উচিত অবিলম্বে সমস্ত স্থাপনার 'রিস্ক প্রোফাইল' বা ঝুঁকির ধরণ তৈরি করা এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা। বিপদ যেকোনো সময় আসতে পারে, তবে আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখলে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।
