অক্টোবরে অতিবৃষ্টিতে শীতের আগাম ফসল ক্ষতিগ্রস্ত, সবজির দাম বেড়েছে ৩০–৪০%
আগাম শীতকালীন সবজির প্রভাবে বাজারে দাম কমার কথা থাকলেও এবার বেশিরভাগ সবজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন সবজির দাম গড়ে ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
কৃষক ও বাজার–সংশ্লিষ্টদের মতে, অক্টোবরের শেষদিকে ও নভেম্বরের শুরুতে অস্বাভাবিক ভারী বৃষ্টিপাতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে আগাম শীতকালীন সবজির দাম এবার স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি।
কৃষি–সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষকরা সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে শীতকালীন সবজির চাষ করেন। কেউ কেউ আগস্টে আগাম আবাদ শুরু করেন। ফলে নভেম্বরের শুরু থেকেই বাজারে আগাম শীতের সবজি আসতে থাকে।
তবে এ বছর অক্টোবরে স্বাভাবিকের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ৩০ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত টানা চার দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে সবজি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
ঢাকার বাজারে অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি সবজির
বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহজাদপুর, কারওয়ানবাজার, বাড্ডা ও হাতিরপুল বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতিকেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ১০০–১২০ টাকায়। উচ্ছে/করলা ৮০–১২০, ঢেঁড়শ ৭০–৮০, পটল ৬০–৮০, লাউ ৫০–৮০, বরবটি ৮০–১০০, চিচিঙ্গা ৬০–৮০, বেগুন ৬০–১২০, কাঁচামরিচ ১৪০–২০০, পুরাতন আলু ২৪–৩০, পেঁয়াজ ১০০–১১৫ এবং কাঁচা পেপে ২৫–৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অক্টোবরের শেষদিকে ভারী বৃষ্টির আগের দিন—২৯ অক্টোবর—এসব সবজির মধ্যে শিম প্রতিকেজি ৫০–৮০ টাকা, করলা ও বেগুন ৪০–৮০ টাকা, বরবটি ৫০–৮০ টাকা এবং পটল ৩৫–৮০ টাকা ছিল। অর্থাৎ তিন সপ্তাহ আগেও এসব সবজি ২১–৬৯ শতাংশ পর্যন্ত সস্তা ছিল।
সবজির অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি ভোক্তাদের চাপে ফেলেছে। হাতিরপুল বাজারে সবজি কিনতে আসা শহিদ মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "শীত এলে তো সবজির দাম কমার কথা। এখন উল্টো সবকিছুর দামই বাড়ছে। সংকটের কথা বলা হয়, কিন্তু বাজারে কী নেই? সবকিছুই ব্যবসায়ীদের ইচ্ছেমতো চলছে। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষের তরকারি কেনার সামর্থ্যই থাকবে না।"
ব্যবসায়ীদের দাবি, সরবরাহ কম
ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ঢাকার বাজারে সবজির সরবরাহ কমে গেছে। ফলে তারা বেশি দামে সবজি কিনে এনে বেশি দামেই বিক্রি করছেন।
কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী হান্নান বলেন, "যে অঞ্চলগুলো থেকে সাধারণত শীতের মৌসুমি সবজি আসে, সেসব এলাকায় এবার প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। এতে আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে সবজি পাঠাতে পারছেন না।"
ডিসেম্বরের শুরুতে অন্য অঞ্চলগুলো থেকে সরবরাহ বাড়তে পারে, তখন বাজারে মালামাল বাড়বে এবং দাম কমার সম্ভাবনা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
একই কথা জানান হাতিরপুলের ব্যবসায়ী মনির হোসেন। তিনি বলেন, "প্রান্তিক এলাকা থেকে এখন পর্যাপ্ত সবজি আসছে না। যে পরিমাণ আসছে, তা দিয়ে চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, চলতি রবি মৌসুমে ৬ দশমিক ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি আবাদ লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ দশমিক ৪৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে।
কৃষকদের অভিযোগ, উৎপাদন কমেছে অর্ধেক
কৃষকরা জানান, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে সবজির উৎপাদন কমে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার বীরকেদার গ্রামের কৃষক আজাহার আলী প্রতি বছর ইজারা নেওয়া জমিতে সবজি চাষ করেন। এবার তিনি ২০ শতকে পটল ও ১৪ শতকে বেগুন চাষ করেছেন। তিনি আজ দুপচাঁচিয়া হাটে পটল ৭০ টাকা এবং বেগুন ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন।
চলতি মৌসুমের উৎপাদন সম্পর্কে তিনি বলেন, "গত কয়েক বছরে এমন সংকট হয়নি। অসময়ের বৃষ্টিতে পটল–বেগুনে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তাই এবার উৎপাদন অর্ধেকেরও কম। বাজারে দাম বেশি হওয়ার এটিই কারণ।"
গত বছর এ সময়ে ফুলকপি বিক্রি হয়েছিল কেজিতে ৩০–৪০ টাকায়। এবার দাম ৬০–৭০ টাকা। এর ব্যাখ্যায় নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলাভাণ্ডারপুরের কৃষক আলাউদ্দিন মণ্ডল বলেন, "১০ কাঠা জমিতে ফুলকপি করেছি। অর্ধেকেরও কম ফলন হয়েছে। অন্যান্য সবজিতেও একই অবস্থা।"
বগুড়ার কাহালুর তিনদিঘী এলাকার কৃষক একাব্বর আলী বলেন, "আগাম শীতকালীন সবজিতে ফুল আসার সময়ে হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ায় অনেক ফুল ঝরে যায়। পরে বৃষ্টি থামলে আবার ফুল ধরে, কিন্তু উৎপাদন অর্ধেকের বেশি হয়নি।"
"গত বছর যেখানে ১০ মণ সবজি পেয়েছি, এবার ৩ মনও ওঠে না। দাম ভালো থাকায় কৃষক বেঁচে যাচ্ছে, নইলে আলুর মতো নিঃস্ব হয়ে যেতাম," যোগ করেন তিনি।
'অতিবৃষ্টি ও রোগবালাইয়ের কারণে উৎপাদন কমেছে'
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ টিবিএসকে বলেন, "অক্টোবরে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে সবজির অনেক ক্ষতি হয়েছে। বৃষ্টির ফলে রোগ–বালাই বাড়ে, এতে সবজির উৎপাদনশীলতা কমে যায়। ফলে কৃষককে উৎপাদন খরচ তুলতে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে অনেকে আগাম সবজি চাষ করেননি। সার্বিকভাবে মৌসুম পিছিয়েছে, তাই বাজারদরও বেশি।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বগুড়ার প্রতিনিধি খোরশেদ আলম)
