এবার শ্রম অধিকার ইস্যুও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারবে আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে কারখানা নিরাপত্তা তদারকির সবচেয়ে বড় জোট আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)—যা আগে 'আকর্ড' নামে পরিচিত ছিল—এবার নিরাপত্তা ইস্যুর পাশাপাশি শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও তদন্ত করার ক্ষমতা পেয়েছে।
এর ফলে কোনো কারখানায় বৈদ্যুতিক, অগ্নি বা স্থাপত্য–নিরাপত্তা–সংক্রান্ত তদন্তের বাইরে অন্য যেকোনো শ্রম–অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও এখন আরএসসি তদন্ত করতে পারবে। তারা এসব বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করে সমাধানের নির্দেশ দিতে পারবে, এমনকি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কারখানার বৈশ্বিক ক্রেতাদেরও অবহিত করতে পারবে। আর এতে কোনো কারখানার ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হতে পারে।
গত ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বোর্ড সভায় নিরাপত্তা ইস্যুর বাইরে শ্রম–অধিকার বিষয় যুক্ত করার প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। তবে বোর্ডে থাকা কারখানা–মালিক প্রতিনিধিরা এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন, যদিও বোর্ডের অন্য সদস্যদের—বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি—সম্মতিতে সিদ্ধান্তটি পাস হয়।
বর্তমানে আরএসসির আওতায় রয়েছে ১,৮৮৫টি কারখানা, যেগুলোর নিরাপত্তা বিষয় তারা তদারকি করছে। আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে প্রাথমিকভাবে ৫৮টি বৈশ্বিক ব্র্যান্ডের পোশাক উৎপাদনকারী ১,১৮৫টি কারখানায় নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শ্রম–অধিকার বিষয়গুলো দেখা হবে। ছয় মাস পর আরএসসির আওতাধীন সব কারখানাই এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হবে।
আরএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল হক বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যেই একটি চিঠির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোকে অবহিত করেছেন। চিঠির একটি অনুলিপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কাছেও এসেছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এখন থেকে আরএসসি অন্যায্য চাকরিচুক্তি ও ছাঁটাই, মজুরি, ভাতা ও ছুটির অধিকার, সংগঠন গঠনের স্বাধীনতা ও সমষ্টিগত দরকষাকষি, শিশু শ্রম, জবরদস্তিমূলক শ্রম এবং বৈষম্য–সংক্রান্ত অভিযোগও তদন্ত করতে পারবে।
এখন থেকে আরএসসি'র সদস্যভুক্ত যেকোনো কারখানায় এসব বিষয়ে কোনো অনিয়ম সংক্রান্ত অভিযোগ পেলে তা তদন্ত করে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে আরএসসি।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ১,১০০ এর বেশি শ্রমিক নিহত হওয়ার পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা তদারকির জন্য দুটি উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ ছিল 'আকর্ড বাংলাদেশ', যার আওতায় ছিল ১,৫০০–এর বেশি কারখানা।
২০২০ সালে আকর্ডের কার্যক্রম শেষ হলে সেটি রূপ নেয় আরএমজি সাসটেইনেবিলিটি কাউন্সিল (আরএসসি)–এ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই উদ্যোগ নেওয়ার পর বাংলাদেশের পোশাক খাতের নিরাপত্তা মানে উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
শিল্প সংশ্লিষ্টদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া
নতুন এই ক্ষমতা আরএসসিকে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের অনুমতি দিলেও বিষয়টি নিয়ে কারখানা মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, শ্রমিক নেতারা একে শ্রম অধিকার সুরক্ষার ক্ষেত্রে বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন।
আরএসসির বোর্ড সদস্য ও ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আখতার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এই সিদ্ধান্তে খুশি, কারণ এতে অন্যায্য শ্রমচর্চা বন্ধ হবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের পথ সহজ হবে। এতে শ্রমিকদের ন্যায়বিচার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।"
তিনি আরও বলেন, "২০ অক্টোবরের বোর্ড মিটিংয়ে প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে কারখানা মালিকরা আপত্তি জানালেও, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে তা গৃহীত হয়।"
আরএসসি নতুন যেসব বিষয় দেখবে, তার মধ্যে ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠন গঠনের স্বাধীনতা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাবে উল্লেখ করে বাবুল আখতার বলেন, "শ্রমিকরা যদি শ্রম অধিকার লঙ্ঘন–সংক্রান্ত কোনো অভিযোগ করে, আরএসসি তা তদন্ত করে নিষ্পত্তির চেষ্টা করবে। মালিকপক্ষ না শুনলে ব্র্যান্ডগুলোকে জানানো হবে, ফলে অর্ডার বাতিল বা আন্তর্জাতিক চাপের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।"
অন্যদিকে মালিকপক্ষ মনে করছে, শ্রম–অধিকার সংক্রান্ত বিষয় তদন্তের ক্ষমতা আরএসসিকে দেওয়া শিল্পের জন্য সহায়ক নয়, বরং ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তাদের মানসিকতা শিল্পবান্ধব নয় এবং কাজের ধরণও সাপোর্টিভ নয়—যা তাদের অতীত কার্যক্রমে প্রমাণিত। ফলে শ্রম অধিকার তদন্তের নামে বাংলাদেশের শিল্পক্ষেত্রের ক্ষতি হতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "শ্রম অধিকার দেখভালের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম আছে, দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ও আছে। এটি আরএসসির কাজ নয়। আমাদের আপত্তি আমরা ইতোমধ্যে জানিয়েছি।"
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, "কারখানাগুলো সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স অডিটের আওতায় এসব বিষয় ব্র্যান্ডগুলোকে জানায়। নতুন করে এটি আরএসসির আওতায় এলে খরচ আরও বেড়ে যাবে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, "আরএসসির এই নতুন উদ্যোগের মাধ্যমে তারা কারখানার অর্ডার বন্ধ করারও সুযোগ নিতে পারে।"
