দেশের পোশাক শিল্পের সূতিকাগার চট্টগ্রাম কেন পিছিয়ে পড়ছে?

বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকেই। ১৯৭৭ সালে কালুরঘাট শিল্প এলাকায় প্রায় ৯ একর জমির ওপর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নুরুল কাদের প্রতিষ্ঠা করেন দেশের প্রথম রপ্তানিমুখী কারখানা—দেশ গার্মেন্টস। সেখান থেকেই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পখাতের।
সেই থেকে বিকশিত হতে হতে এই শিল্পের আকার আজ প্রায় ৪,৮০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশব্যাপী রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের প্রসার ঘটলেও চট্টগ্রামে পিছিয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে নিবন্ধিত পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬২০টি হলেও বর্তমানে চালু রয়েছে ৩৪৩টি। বাকি ২৭৭টি বন্ধ হয়ে আছে। এখানকার সক্রিয় কারখানাগুলোতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।
অন্যদিকে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নিবন্ধিত তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান ১১০টি। এর মধ্যে ৯১টি রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার দুই সংগঠনের সঙ্গেই নিবন্ধিত।
বর্তমানে চট্টগ্রামের অবদান মোট রপ্তানির প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের পোশাক রপ্তানির ১০–১২ শতাংশ। অথচ একসময় দেশের ৪০ শতাংশ রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা ছিল চট্টগ্রামে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, অবকাঠামো উন্নয়নে বিলম্ব, দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি–বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকায় এ শিল্পশহর পিছিয়ে গেছে।
চট্টগ্রামে শুরু ও সম্প্রসারণ
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে নুরুল কাদের সরকারি চাকরি ছাড়েন। ব্যবসায় মনোযোগ দিয়ে তিনি পরে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে দেশ গার্মেন্টস গড়ে তোলেন। কারখানা চালুর আগে ১৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দক্ষিণ কোরিয়ায় নিয়ে গিয়ে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তারাই দেশের তৈরি পোশাক খাতের বিস্তৃতি ঘটান। কেউ কেউ পরে কারখানা মালিকও হয়েছিলেন। এভাবে শুরু হয়েছিল দেশের প্রধান রপ্তানি খাত।
খাত সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, শুরুর দিকে চট্টগ্রামে এ খাতের বিস্তার ঘটে মূলত মার্কিন কোটার সুযোগ কাজে লাগিয়ে। আশির দশকে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পোশাকের ক্রয়াদেশ দেওয়া হতো কোটার মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালে কার্যকর হওয়া মাল্টিফাইবার চুক্তির (১৯৭৪–৯৪) আওতায় এই কোটা পেত বাংলাদেশও। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে অসংখ্য কারখানা। আর রপ্তানি খাতকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড) প্রতিষ্ঠা করে।
১৯৯৪ সালে মাল্টিফাইবার চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও, ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার 'দ্য অ্যাগ্রিমেন্ট অব টেক্সটাইল ও ক্লথিংয়ের (এটিসি)' আওতায় নতুন করে আবারও কোটাসুবিধা চালু হয়—যা ২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল ছিল।
এই সময়ে বন্দরনগরী চট্টগ্রামকে কেন্দ্র করে মূলত মার্কিন বাজারনির্ভর একটি রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের বলয় তৈরি হয়। এশিয়ান, প্যাসিফিক, কেডিএস, ক্লিফটন এবং ইয়াংওয়ানের মতো শিল্প গ্রুপের হাত ধরে এই খাত আরও সমৃদ্ধ হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াংওয়ান ১০০ কোটি ডলারের রপ্তানির মাইলফলক অতিক্রম করে, আর প্যাসিফিক জিন্স আজও বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছে।
জাপানের বহুজাতিক খুচরা বিক্রেতা ইউনিক্লো তাদের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। এছাড়া সিঅ্যান্ডএ, টেসকো, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার এবং টম টেইলরের মতো ব্র্যান্ডের জন্যও তারা পোশাক তৈরি করে। প্যাসিফিক জিন্স এখন বিশ্বের ৫২টি দেশে পণ্য রপ্তানি করে।
অবকাঠামোগত দুর্বলতায় পিছিয়ে পড়া
বিজিএমইএর তথ্য বলছে, ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০টি নতুন কারখানা স্থাপিত হয়। কিন্তু ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা কমে বছরে প্রায় ১৭টিতে দাঁড়ায়। আর ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০টিরও কম নতুন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এই সময়ে অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, কয়েক দশকে নতুন কারখানা স্থাপনের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে।
এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুস সালাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'মূলত ২০০৫ সাল থেকে তৈরি পোশাক খাতের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিল। আর তখন থেকে চট্টগ্রামে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করা হয়। কিন্তু বিপরীতে ঢাকার আশপাশের এলাকাগুলোতে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়েছিল। ফলে তখন সেখানে টেক্সটাইল, স্পিনিংসহ তৈরি পোশাক খাতের কারখানা গড়ে উঠেতে শুরু করে। ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে আইসিডির বন্দরের সুবিধা পেতে শুরু করলেন ঢাকার কারখানা মালিকেরা। তখন সেখান দ্রুত সম্প্রসারণ হয়।'
আর চট্টগ্রামের তুলনায় ঢাকার আশপাশের শিল্প এলাকাগুলোর জমির দাম কম হওয়া ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, 'জমির পেছনে যদি ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়, তাহলে তো আর যন্ত্রপাতি কেনার টাকা থাকে না। এটিও একটি বড় কারণ ছিল। ইউরোপের ক্রেতারা ঢাকায় এসে সহজে কাজ শেষ করে ফিরে যেতে পারতেন, কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত ছিল।'
সম্প্রসারণের যুগে চট্টগ্রামের যোগাযোগব্যবস্থার কারণে তৈরি পোশাক খাত পিছিয়ে পড়তে হয়েছে বলে মনে করেন ক্লিফটন গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ভাঙাচোরা ছিল। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো ছিল না। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ছিল না। ব্যাংকিং সুবিধাসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হয়ে যায়। এসব কারণে চট্টগ্রাম পিছিয়ে পড়েছে। একসময় তৈরি পোশাক রপ্তানির ৪০ শতাংশ চট্টগ্রাম উৎপাদন হতো। বর্তমানে তা ১০ শতাংশের আশপাশে নেমে এসেছে।'
সম্ভাবনার হাতছানি
গত দুই দশকে পিছিয়ে পড়লেও চট্টগ্রামের সম্ভাবনা এখনও শেষ হয়ে যায়নি বলে মনে করেন এ খাতের উদ্যোক্তারা। ক্লিফটন গ্রুপের মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, এলএনজির মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ অব্যাহত থাকলে এবং মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইউটিলিটি সুবিধা ও একটি গার্মেন্টস ভিলেজ প্রতিষ্ঠা করা হলে চট্টগ্রামে আবারও পোশাক খাতের সম্প্রসারণ সম্ভব।
এশিয়ান গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ আবদুস সালামের ভাষ্যে, 'যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও ইউরোপের দেশগুলো রপ্তানি বাড়াতে আমরা কাজ করছি। এক্ষেত্রে সরকারকে নীতিগত সহায়তা দিতে হবে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি সমাধান করা গেছে। সামনে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিয়ে ভাবতে হবে। এখনও বাংলাদেশ প্রস্তুত নয়। সরকারের নীতিগত সহায়তা পেলে তৈরি পোশাক খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে।'