জোট হলেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন: আরপিও সংশোধনী নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর
নির্বাচনী জোট গঠিত হলেও প্রার্থীদের নিজ নিজ দলের প্রতীকে জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে—এমন বিধান যুক্ত করে নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। তবে এ সংশোধনী নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
কিছু রাজনৈতিক দল এই বিধানের বিরোধিতা করলেও অনেকে একে স্বাগত জানিয়েছে। সংশোধিত আরপিওতে জোটবদ্ধ রাজনীতিতে অনিবন্ধিত ছোট দলগুলো কিছু সুবিধা পাবে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।
তাদের মতে, অল্প সময়ের জন্য এই নিয়ম ছোট দলগুলোর জন্য কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ফলপ্রসূ হবে। এতে ছোট দলগুলোর নিজস্ব প্রতীক ধীরে ধীরে পরিচিতি পাবে, নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় গড়ে তুলতে পারবে। তবে অনেকে পরামর্শ দিয়েছেন, বিদ্যমান পদ্ধতিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক এবং পরবর্তী নির্বাচন থেকে সংশোধিত আরপিও কার্যকর করা হোক।
আরপিও সংশোধনী নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এই খসড়ায় পরিবর্তন আনার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তারা চিঠি দেবে।
আপত্তির কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, "জোটবদ্ধ নির্বাচনে নিজস্ব দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হলে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হতে উৎসাহিত হবে না। এতে তাদেরও সম্মতি নেই, আমাদেরও নেই। এটা নির্বাচন কমিশন একতরফাভাবে কেন তুলল, জানি না। আমার মনে হয়, সুষ্ঠু রাজনীতি ও নির্বাচনের স্বার্থে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন।"
বিএনপি আপত্তি জানালেও আরপিও সংশোধনীতে জামায়াতে ইসলামীর আপত্তি নেই। দলটির একটি সূত্র জানায়, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রতীক আছে; তারা সেই প্রতীকেই নির্বাচন করবে—এতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি। দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আরপিও সংশোধনী নিয়ে আমাদের অবস্থান আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে মিটিংয়ে জানানো হবে।" তিনি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ বিষয়ে শিগগিরই বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের বাধ্যবাধকতাকে সমর্থন করেছে ন্যাশনাল কনসেনসাস পার্টি (এনসিপি)। দলটির নেতা আখতার হোসেন বলেন, "আমরা সংশোধনীটিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি।"
বিএনপির আপত্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "বিএনপি তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে। যদি কোনো দলের কারণে সরকার এই সংশোধনী থেকে সরে আসে, তাহলে আবারও প্রতীয়মান হবে যে সরকার লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার দিকে এগোচ্ছে।"
লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ টিবিএসকে বলেন, "প্রত্যেক দলের আত্মসম্মান থাকা উচিত। আত্মসম্মান না থাকলে রাজনীতি করা ঠিক নয়। জোটে থাকলেও প্রত্যেক দলের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করা বাঞ্ছনীয়। এতে দলের আত্মমর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে।"
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধন ২০২৫-এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ। গত বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় এ সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও নিজেদের প্রতীকে অংশ নিতে হবে—আরপিওর এমন সংশোধনীর প্রসঙ্গে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক টিবিএসকে বলেন, "আমরা আরপিও সংশোধনীকে ইতিবাচক হিসেবে দেখি। নিবন্ধন পাওয়ার পর নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব। তবে ছোট দলগুলোর জন্য এটা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। কিন্তু নিজ দলের পরিচয়ে রাজনীতি করতে হলে এতটুকু ঝুঁকি নিতেই হবে।"
তবে তিনি হঠাৎ এ সংশোধনী নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সাইফুল হক বলেন, "আলোচনা ছাড়া হঠাৎ এমন সংশোধনী এলে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হতে পারে। আগামী নির্বাচন বিদ্যমান পদ্ধতিতেই হওয়া উচিত, পরবর্তী নির্বাচনে নিজ প্রতীকের বিধান কার্যকর করা যেতে পারে।"
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান টিবিএসকে বলেন, "একটা দলকে নিবন্ধিত করে প্রতীক দেওয়া হয়। নিজ প্রতীকে নির্বাচন না করলে নিবন্ধিত হওয়ার কোনো মানে হয় না। এতে দলের নিজস্ব পরিচিতিও গড়ে ওঠে না, প্রতীকের বিষয়েও মানুষ অজ্ঞাত থেকে যায়। তাই আরপিও সংশোধনীর সিদ্ধান্ত সঠিক—এতে দলগুলোর বিকাশ ঘটবে। মানুষ বুঝে-শুনে ভোট দিতে পারবে, কোন দলের, কোন আদর্শে ভোট দিচ্ছে তা অনুধাবন করতে পারবে।"
বাংলাদেশ জাতীয় দল-এর চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদা টিবিএসকে বলেন, "এই সিদ্ধান্ত ভালো হয়নি। আগের নিয়মই থাকা উচিত ছিল। এটা কোনো সংস্কার নয়। আরপিও সংশোধনীতে দলগুলোর ইচ্ছার প্রতিফল নেই, বরং আইন করে তাদের ইচ্ছাকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এতে দলগুলোর স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করা হচ্ছে, যা ঠিক নয়।"
তিনি আরও বলেন, "নিবন্ধিত ছোট রাজনৈতিক দলগুলো এই সংশোধনীতে ভুক্তভোগী হবে। অনিবন্ধিত দলগুলোর কোনো প্রতীক না থাকায় তারা জোট করে বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে পারবে, কিন্তু নিবন্ধিত ছোট দলগুলোকে নিজেদের প্রতীকে ভোট করতে বাধ্য হতে হবে।"
গণ অধিকার পরিষদ-এর সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান টিবিএসকে বলেন, "এ ক্ষেত্রে দুই ধরনের স্বাধীনতা থাকা উচিত। রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী জোট করে মূলত কৌশলগত কারণে—জয়ের সম্ভাবনা বাড়ানোর জন্য। কেউ যদি মনে করে জোটের একটি প্রতীকে সবাই নির্বাচন করবে, সেটাও গ্রহণযোগ্য। আবার কেউ যদি মনে করে, জোটে থেকেও নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করবে, সেটাও হতে পারে। দুই ধরনের বিকল্প রাখাই শ্রেয়।"
জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা)-র সহসভাপতি ও দলীয় মুখপাত্র রাশেদ প্রধান টিবিএসকে বলেন, "আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জোটগত নির্বাচনের সময় ছোট দলগুলো সাধারণত বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করে। ফলে দেশের মানুষ খুব বেশি প্রতীকের সঙ্গে পরিচিত নয়। এ কারণে ছোট বা মাঝারি দলগুলো চাইছে, জোটে থাকলে বড় দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে।"
তবে জোটে থাকলেও নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে—এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন, "যুগ যুগ ধরে দুই-তিনটি প্রতীকই বেশি পরিচিতি পেয়েছে। এই সংস্কৃতি থেকে আমাদের বের হয়ে আসা উচিত। নিজ প্রতীকে নির্বাচন করলে হয়তো প্রথমদিকে মানুষকে জানাতে কষ্ট হবে, কিন্তু ধীরে ধীরে প্রতীকগুলোর পরিচিতি বাড়বে।"
